জানা অজানার মাঝে ক্যামেলিয়া!



নে বাদাড়ে, পথে ঘাটেনদীর তীরে আবার কখনও বা পুরোনো বাড়ির দেয়াল বেয়ে কত হরেক রকমের ফুল ফুটার দেখা মেলে। যাদের মধ্যে কিছু ফুল আমাদের চেনা, আবার কিছু ফুল অচেনা। তবে আজ বলব ক্যামেলিয়ার কথা! এর নাম হয়তো আমরা শুনেছি কিন্তু অনেকেই হয়তো কখনো দেখিনি বা ফুলটি নিয়ে তেমন জানাও হয় নি।

শুরুতে শোনা যাক ক্যামেলিয়া নিয়ে কিছু মজার ইতিহাস! সতেরশ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বৃদ্ধ ক্যামেলিয়া গাছগুলোকে ভূতপ্রেতের আড্ডাখানা হিসেবে ধরা হত। জাপানি সামুরাই যোদ্ধারাতো একে যুদ্ধের জন্যে একেবারেই অশুভই মনে করত। তাই সামুরাই যোদ্ধারা যুদ্ধে যাওয়ার আগে এসব ফুলের টব সরিয়ে ফেলতো, কিংবা ফুলের টব বাগানের পেছনের সারিতে রেখে দিত। তবে কেবল সাদা ক্যামেলিয়াই এই বদনাম থেকে বেঁচে যেত।


ক্যামেলিয়ার বৈজ্ঞানিক নাম হল Camellia Japonica, আর ডাক নাম BURBON CAMELIA. Japonica নামটি এসেছে এনপেলবারট ক্যাস্পার থেকে, তিনিই জাপান থেকে প্রথম এই ফুলটির নাম বিশ্ববাসীকে শুনিয়েছিলেন। ক্যামেলিয়া নাম টি এসেছে জেস্যোইট পাদ্রী ও উদ্ভিদবিদ  জর্জ ক্যামেল থেকে। উদ্ভিদবিদ ক্যারোলাস লিনিয়াস একে "ক্যামেলিয়া জাপোনিকা" বলেই অভিহিত করেছেন। আর কোনো কোনো দেশে ক্যামেলিয়াকে "THE ROSE of WINTER" (শীতের গোলাপ) ও বলা হয়।এই ফুল শীত এ ফুটলেও এরা কিন্তু ভীষণ বৃষ্টিপ্রিয়। তবে গাছের গোড়ায় যদি পানি জমে থাকলে সেটি বেশিদিন টিকে না!


 ক্যামেলিয়ার সৌন্দর্যের জন্যে যুগে যুগে এর  কদর ছিল দারুণভাবে সমাদৃত। ১৭৩৯ সালে রবার্ট জেমস ইংল্যান্ডে এই গাছ নিয়ে যান। সেই থেকে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে ক্যামেলিয়া। আমেরিকার নার্সারিগুলোতে ১৮০৭ সাল থেকে গ্রিন হাউস ট্রি হিসেবে চাষ শুরু হয়। আর এখন তো ইউরোপ আমেরিকার যে কোন অভিজাত বাগানে এই ক্যামেলিয়া থাকবেই!


 শুধু ইতিহাসেই নয়, সাহিত্যের পাতায়ও স্থান দখল করে নিয়েছে এই ক্যামেলিয়া। ক্যামেলিয়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে কবিগুরু লিখেছিলেন-
"যেদিন নেমে আসব তার দুদিন আগে তনুকা বললে,
একটি জিনিস দেব আপনাকে, যাতে মনে থাকবে আমাদের কথা- একটি ফুলের গাছ।'
এ এক উৎপাত। চুপ করে রইলাম।
তনুকা বললে' দামি দুর্লভ গাছ,
এ দেশের মাটিতে অনেক যত্নে বাঁচে।'
জিজ্ঞেস করলেম- 'নামটা কি?'
সে বললে- 'ক্যামেলিয়া।"

 সাহিত্যে এমন রোমান্টিক অভিব্যাক্তি খুবই দুর্লভ, যা কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ক্যামেলিয়া' কবিতায় ক্যামেলিয়ার সৌন্দর্যের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এছাড়াও জন এলিনের লেখা 'দ্য ফোরটি সেভেন রোনিন স্টোরি' উপন্যাসে ও ফুলের বর্ণনা আছে।

এই ফুল সাধারণত আমাদের দেশে দুষ্প্রাপ্য। তবুও মৌলভীবাজার এবং শ্রীমঙ্গল এর কিছু চা বাগানে এদের দেখা মেলে। এর প্রজাতি সংখ্যা ৪৫। আরও নতুন প্রজাতির অপেক্ষায় বিজ্ঞান জগৎ।বর্তমানে বিভিন্ন রঙের এই ফুল চাষ হলেও নীল ক্যামেলিয়া চাষ  আবিষ্কারের গবেষণা চলছে। বর্তমানে ক্যামেলিয়ার  মধ্যে এলিগানস হলো বড়, টকটকে লাল ও তাতে মাঝে সাদা ডোরা দাগ থাকে। গুলিও নুসিও হলো লাল ও গোলাপি রং এ পূর্ণ, যার পুংকেশর হলুদ।মাথোটিনা আলবা ধ্রুপদী সাদা ফুল দ্যা সিজার হালকা ক্রিমসন সেমি ডাবল পাপড়ির ফুল। তবে সবচেয়ে মূল্যবান ও গৌরবময় স্থান ধরে রেখেছে "আলবা প্লিনা"।


 ক্যামেলিয়া চির সবুজ গোত্রের গাছ। যেখানে জন্মে  সেখানে গাছ প্রায় ১০ মিটার উচু হলেও আমাদের দেশে তা হয় ২ থেকে ২.৫ মিটার।  বাংলাদেশে এ ফুল চাষের জন্যে একটু ছায়াযুক্ত স্থান প্রয়োজন, তাই চা বাগানে এ ফুল চাষ করা যেমন সুবিধাজনক, তেমনি তা বাড়ায় বাগানের সৌন্দর্যও।  ছায়াঘরে এ ফুল চাষ সুবিধাজনক, কারণ ৬০-৬৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা চাষের জন্যে খুবই উপযোগী। ক্যামেলিয়া গাছ বাঁচে প্রায় ১০০ বছর। ১৯৩৬ সালে ঢাকার বলধা গার্ডেনে এই ফুলের চাষ এদেশে প্রথম শুরু হয়।  দূর থেকে এই ফুলের গাছ যেন সবুজের মন মাতান নিকুঞ্জ। সারাবছরে যখন একবার ফুল ফোটে, তখন তাতে যেন ফুটে উঠে প্রিয়তমার এক অপরূপ সৌন্দর্য!

ফুল মানেই সুন্দরের প্রতীক, আর ক্যামেলিয়া সেই সৌন্দর্যকে করেছে আরো মহিমান্বিত, আর যুগে যুগে মানুষের মনে সৃষ্টি করেছে আবেদন।

Comments

Popular posts from this blog

মজার খেলা ডার্ট বোর্ড

হাই – লাইন ডিফেন্স ইন ফুটবল

সংখ্যা দিয়ে বন্ধুত্ব!!!