নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে



প্রিয় ম্যাজিসিয়ান,

খুব ছোট্ট একটা সম্ভাষণ দিলাম। কেমন আছেন? আচ্ছা থাক, বলা লাগবে না। জানেন, খুব ইচ্ছে আমার, শুধু আমি বলব, আপনাকে কিছু লিখব, আজ নাহয় ইচ্ছেটা পূর্ণ হোক। তবে শুনুন…

তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। পাঠ্যবইয়ের বাইরে খুব একটা বইটই পড়তাম না। বাসায় অবশ্য বইয়ের ভাল রকম একটা সংগ্রহ ছিল মামার সুবাদে। মামা খুব গল্পের বই পড়ত। তো একদিন আর কাজটাজ না পেয়ে বসে আছি, পরীক্ষাও শেষ, করার তেমন কিছু নেই। কি আর করা, শেলফ থেকে একটা বই নামালাম। দেখি, কিছুটা সময় কাটে কিনা। নিম্নবিত্ত পরিবারের মিতু নামের এক মেয়েকে নিয়ে ছিল বইটার কাহিনী। যার জীবনটা ছিল খুব দুঃখের, কিন্তু উপন্যাসের শেষে সবচে সুখী ছিল সেই মেয়েটি। একনিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললাম বইটা, নিজেও যেন টের পেলাম না। অন্য এক ভাললাগা পেয়ে বসল, অন্য এক জগত খুলে গেল আমার চোখে। বইটার নাম ছিল- পেন্সিলে আঁকা পরী। লেখক হুমায়ূন আহমেদ।

এরপরেই পেয়ে গেল গল্পের বইয়ের নেশা। শেলফ থেকে একের পর এক বই নামাতে থাকলাম। কি রাত কি দিন, চোখের সামনে শুধু বই। জানেন, একটা দিনও হূমায়ূন ছাড়া থাকতে পারতাম না। দারুচিনি দ্বীপ, কৃষ্ণপক্ষ, জল জোছনা, আমার আছে জল, সাজঘর, জনম জনম,দুই দুয়ারী, দিনের শেষে,শ্রাবণ মেঘের দিন, বহুব্রীহি, এপিটাফ – এসবে হারিয়ে গেলাম। একদম চোখের সামনে যেন আপনার গল্পটাকে দেখতে পেতাম, গল্পের চরিত্রগুলো যেন একদম জীবন্ত! বিশেষ করে, একজন মায়াবতী’তে মীরার প্রতি মনজুরের এক অন্যরকম ভালবাসা, দারুচিনি দ্বীপের শুভ্র (ওরফে কানা বাবা)-জরী-অয়ন,  আকাশজোড়া মেঘের অপালার কাহিনী , কবি উপন্যাসে নীতু নামের এক মায়াবতীকে শেষ পর্যন্ত কবি আতাহারের না বলা অব্যক্ত কিছু কথা- স্পর্শ করে যায় মন। বইগুলো পড়ার সময় যেন মনে হত, ঘটনাগুলো যেন সত্যিই বাস্তব, আমিও যদি এদের মত হতে পারতাম, কখনও কবি আতাহারের মত, কখনও বা শুভ্র, কখনও বা মনজুর,কোথাও কেউ নেই এর বাকের ভাই কিংবা আকাশজোড়া মেঘের ফিরোজ...আরো কত কত চরিত্র!  


খুব অবাক হতাম হিমু আর মিসির আলী পড়লে। পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবীর হিমুর পাগলামী যে কতবার নিজের মধ্যে নেয়ার চেষ্টা করেছি! আমার কি ধারণা জানেন, যারাই হিমু পড়ছে, প্রত্যেকেই জীবনে একবার হলেও হিমু হওয়ার চেষ্টা করেছে, হলুদ পাঞ্জাবী পরে খালি পায়ে হাটতে চেয়েছে, তীব্র জোছনায় হা করে চাঁদের আলো খাওয়ার চেষ্টা করেছে,সে আলো মাখতে চেয়েছে সারা শরীরে, তার মত রহস্যমানব হবার চেষ্টা করেছে, নীল শাড়ির রূপাকে দিতে চেয়েছে বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল। কেউ কি পেরেছে? আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি? বাস্তবে আপনি কখনও কোন হিমুকে দেখেছেন, ঠিক আপনার বইয়ের সেই হিমু?

মিসির আলিও কম যান না। খুব জটিল রহস্য, শুরুতে মনে হয় কোন সমাধান নেই,অথচ এই লোকটি কত সহজেই না সব রহস্যের সমাধান করে ফেলতেন,যুক্তি দিয়ে কোন কিছু ভাবাটা তার থেকেই যেন শেখা, তার কথা শুনেই মনে হত, যুক্তির বাইরে যেন কিছুই নেই এ জগতে। আপনি সবসময়ই বলতেন, প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে,সে চায় না সব রহস্য আমরা বের করে ফেলি। কালো জাদুকরের টগরের রহস্য যেমন ধরতে পারেনি কেউ।সবাই যদি সুপ্তি মেয়েটার মত ভাল হত, সত্যিই যদি টগরের মত বৃক্ষমানব হয়ে থাকা যেত, কতই না ভাল হত! 

স্কুলে থাকবার সময়, শুধু আপনার বই কিনবার জন্যে টাকা জমাতাম, কিছু জমলেই নিউমার্কেটের পুরনো বইয়ের দোকানে ছুটে গিয়ে শুধু একটা জিনিসই খুঁজতাম- হুমায়ূন। কি ছিল না সেসব বইগুলোতে! এলেবেলের গল্পগুলো পড়লে আর হাসির দম আটকে রাখা যেত না। বাদশাহ নামদার পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, নিজেই যেন সেই যুগে চলে গেছি, বাদশাহ হুমায়ূন যেন আমার সামনেই!  মাতাল হাওয়া, সম্রাট, দেয়াল- ইতিহাসের উপর এমন করে আর কি কেউ এরকম সুন্দর করে লিখতে পেরেছে?

প্রিয় লেখক, আপনার বই পড়েই শিখেছি, কিভাবে চন্দ্রস্নাত হতে হয়, বাদল দিনের প্রথম বৃষ্টিতে ভিজতে হয়, নক্ষত্রের রাতে সবচে উজ্জ্বল নক্ষত্রটার দিকে সব ভুলে তাকিয়ে থাকতে হয়। একটা কিশোরের সেই বয়সের কল্পনার জগতকে এই বইগুলো নিয়ে গেছে এক অন্য জগতে, করে তুলেছে রঙ্গিন। প্রিয় কারিগর, কেন এত ভাল লিখেন? লিখেন বললাম, কারণ বিশ্বাসই হতে চায় না, আপনি লিখতেন। আপনার চলে যাওয়াকে সত্যিই এখনো বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করি না আর কখনো কেউ চান্নি পসর নিয়ে লিখবে না, হিমু, মিসির আলি, বাকের ভাই, শুভ্রকে নিয়ে লিখবে না। এখনো বইয়ের দোকানে আপনাকে খুঁজে ফিরি, বারবার,দরজার ওপাশে। 

চন্দ্র কারিগর, আজ ১৯ শে জুলাই। চলে যাওয়ার পাঁচ বছর হয়ে গেল।

ময়ূরাক্ষীর তীরে  একা বসে আছি। কোথাও কেউ নেই। চান্নি পসর চলছে, সারা গায়ে মাখছি সেই আলো। ময়ূরাক্ষীর জল তার অঙ্গে সেই আলো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূরে কোথাও। রাতের আকাশ জুড়ে অনন্ত নক্ষত্র বীথি।

চন্দ্র কারিগর, আজ আমার মন ভাল নেই... 






Comments

Popular posts from this blog

মজার খেলা ডার্ট বোর্ড

হাই – লাইন ডিফেন্স ইন ফুটবল

সংখ্যা দিয়ে বন্ধুত্ব!!!