পরম্পরা (শেষ পর্ব)


*আগের পর্ব- পরম্পরা(পর্ব- ৩)





শেষ পর্ব............

অভি এখন খুবই ব্যস্ত সময় পার করছে। প্রতিদিন একটা রোগ নিয়ে আস্তে আস্তে সে গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছে। রোগটার নাম Legionnaires' diseaseকিছু কিছু বিষয় সে ইতোমধ্যেই জেনে গেছে। রোগের মূল লক্ষণ কাশি ছাড়া আর তেমন কিছু নয়। পুরো পৃথিবীতে এই রোগের সংখ্যা মোটে ১০ শতাংশ। আর এই ১০ শতাংশের মধ্যে একজন অন্তরাদিদি আর অন্য আরেকজন মিতার ছেলে। রোগটা মূলত পানিবাহিত।   Legionella  নামক ব্যাকটেরিয়ায় এই রোগ ছড়ায়। রোগটি তেমন জটিল কোন রোগ নয়তবে চিকিৎসায় দেরী হলে ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধে ফুসফুসে। পরে যা থেকে হয় ক্যানসার। অন্তরাদিদির পরিণতিও কি হয়েছিল অভি তা বুঝতে পারে। অযত্ন অবহেলায় দিনের পর দিন এই রোগ বাসা বেঁধেছিল দিদির শরীরে।

পাশ করার পরের বছরই অভি গ্রামে পাড়ি জমায়। গ্রামবাসীদের সহায়তায় সে গ্রামেই একটা ক্লিনিক দেয়। দিন ভালোই যাচ্ছিল তার। পুরোনো গ্রামে ফিরে এসে সে যেন আবার নিজেকে ফিরে পেয়েছিল। তারপর একদিন ক্লিনিকে অভি দেখা পায় মিতার। মিতা সেদিন এসেছিল তার স্বামী আর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। ছেলেটার নাম রাজু। মিতা কেমন যেন আড়ষ্ট ছিল সেদিন। অভির যা কথা মিতার স্বামীর সাথেই হয়। রাজুর নাকি বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই খুব কাশি শুরু হয়। প্রথম প্রথম তারা ভেবেছিলবাচ্চা ছেলে হয়ত ঠান্ডা লেগেছে। কিন্তু এক সপ্তাহ পরও কাশি যাওয়ার নাম নেই। এরপরই তারা ক্লিনিকে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। রাজুকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখে অভি। রাজুর  কয়েকটা টেস্ট করাতে দেয় শহর থেকে। টেস্ট রিপোর্ট দেখে অভি একসময় বুঝতে পারে Legionnaires' disease এ ভুগছে রাজু। রাজুর ফুসফুসেও ছড়িয়ে যেতে শুরু করেছে ব্যাকটেরিয়া। খুব তাড়াতাড়ি অপারেশন না হলে একসময় পুরো ফুসফুসই অকেজো হয়ে যেতে পারে রাজুর। অভি সিদ্ধান্ত নেয় রাজুর অপারেশন সে নিজেই করবে। রাজুর অপারেশন করানোর মত সামর্থ্য ক্লিনিকের আছে। আর রাজুর মা বাবার পক্ষেও সন্তানের চিকিৎসা বাইরে করানো সম্ভব নয়। অভির কয়েকজন ডাক্তার বন্ধুও তার পাশে এসে দাঁড়ায়। অভি হঠাত অনুভব করেএখন যদি মৌমিতা থাকতো তবে অনেক ভালো হতএকসময় দুজনে মিলে পড়াশুনার জটিল ব্যাপারগুলো আলোচনা করতো। সমাধান করত অনেক সমস্যার। অভির সাথে মৌমিতার চিন্তা মনমানসিকতায় এতই মিল ছিল যে অভি সব সময় ভাবতো সে যা চায় মৌমিতাও বুঝি তাই চায়! কিন্তু নাঅভি তার মনের মৌমিতার সাথে বাস্তবের মৌমিতার মিল পায় নি।

অভির আজও মনে আছে সেদিনের কথা! মৌমিতার বাবার সাথে কথা হওয়ার দিন কয়েক পরেই অভি মৌমিতাকে জানায় তার গ্রামের কথাতার স্বপ্নের ক্লিনিকের কথা। মৌমিতা সেদিন অভির সাথে গ্রামে আসতে রাজি হয় নি , এক নিঃশ্বাসে অভিকে সেদিন সে বলেছিল , নাঅভি। এটা হয় না। তোমার স্বপ্ন যে আমার স্বপ্ন হবে এমনটা ভাবা বোকামী। তবেআমার জন্য আমি তোমাকে বাধা দেব নাএটা অন্যায়! তোমার উপর আমার চেয়ে বেশি পাওনা তোমার গ্রামের মানুষদেরতোমার মা বাবারতুমি তাদের কাছে ফিরে যাওকথাগুলো বলে মৌমিতা সেদিন চলে গিয়েছিল। আর ফিরে তাকায়নি। আসলে মৌমিতা চাইলে সেদিন অভিকে আটকাতে পারত। কিন্তু করে নি......... অভি কোন বাঁধনে আটকা পড়ুক এটা সে চায়নি!

অনেক বছরের কথাগুলো আজ অভির আবার মনে পড়ল। মৌমিতা আর অভির খোঁজ নেয়নিএকবারের জন্যও নেয় নি। অভি ভালো করেই জানে মৌমিতাকে সে চিরতরে হারিয়েছেতবুও আজ হঠাত নিজেকে বড্ড অসহায় লাগলো তার। যদি কেও থাকতো……যদি…………!

অপারেশন থিয়েটার। রাজুর অপারেশন শেষ করে অভি বাইরে বের হল। সবাই দাঁড়িয়ে ছিল অভির জন্য। তাকে দেখে জানতে চাইলো রাজুর কথা। সবার সাথে মিতাও আছে। আজ সে মন ভরে মিতাকে দেখতে পারছে। কিন্তু মিতা যেন সেই মুখের মাঝেই একটা পর্দা দিয়ে রেখেছে। চাইলেও সে পর্দা অভি সরাতে পারবে না। ছোটবেলার হঠাত দেখা সেই মিতাকে অভি আর দেখতে পাবে না কোনদিন!

ফলাফল আরো ১ ঘন্টা পর জানা যাবে-অভি সবাইকে বলল। বলে সে একাই তার রুমে চলে গেল। তার মনে নানা প্রশ্ন। সে কি ঠিক মত সব করতে পেরেছেযদি রাজুর কিছু হয়মিতাকে কি জবাব দিবে?এনেস্থেসিয়ার ডোজটা একটু বেশি হয় নি তোঅভি ক্রমশ দুর্বল হয়ে উঠে। যদিও তাকে বাইরে থেকে দেখতে যথেষ্ট স্বাভাবিক মনে হয়। যেন রাজুর কিছু হলে অভির কিছুই যায় আসবে না।



(কয়েক বছর পর..................)
রাজু এখন সুস্থ। সবাই রাজুকে অনেক ভালোবাসে। পড়ালেখায়ও রাজু অনেক ভালো। ভালো পড়াশুনার জন্য রাজুকেও শহরে পাঠানো হচ্ছে। ওখানে ও পড়াশোনা করবে অভির মতই। এই গ্রামে আরেকটা অভি সৃষ্টি হবে। মিতা মাঝে মাঝে রাজুকে নিয়ে অভির চেম্বারে যেত। কিন্তু প্রয়োজনের বাইরে কোন কথা হত না তাদের মধ্যে। মিতা হয়ত কোনদিন জানবে না অভি মিতাকে একসময় কত ভালোবাসতো। অভির জন্য মিতা কিছুই করতে পারে নিকিন্তু মিতার জন্য অভি সব কিছুই করছিল!
                                                                 
                                                              


                                                        (সমাপ্ত)

Comments

Popular posts from this blog

মজার খেলা ডার্ট বোর্ড

হাই – লাইন ডিফেন্স ইন ফুটবল

সংখ্যা দিয়ে বন্ধুত্ব!!!