একটি স্বপ্ন আর মঙ্গলের মাটিতে বাংলা!
- ম্ ম্। ভাবতে দে......... আসলে পৃথিবীটা সবার!
- আচ্ছা! তাহলে বল মঙ্গল কার?
- আমার।
- তোর! মজা করিস না তো। আমি বলি,মঙ্গল আসলে কারোরই না। ওখানে তো কেউ থাকে না।
- নাহ মঙ্গল আমার। আমি বলছি।
- আচ্ছা তুই যদি মঙ্গল এ গিয়ে থাকতে পারিস আর সাথে মানুষের বসতি গড়তে পারিস তাহলে ধরে নিবো মঙ্গল তোর। হা হা হা!
- হুমম.........করবো
- হাসালি! তুই কি পাগল? মঙ্গলে থাকা হয়ত সম্ভব, তবে তা তোর আর আমার জন্য না। আমরা তো দরিদ্র দেশের দরিদ্র দুই ছেলে। মঙ্গলে যেতে অনেক টাকা লাগবে। তুই তো তাও পারবি না।এতো টাকা পাবি কই??? হা হা হা!
- ব্যাপার না।
- পাগল ছাগলের কারখানা দেখি!
- তুই দেখবি একদিন......
সাল ২০৬৩...
আজ মঙ্গলের মাটিতে বসে এসব ভাবছেন মার্স ওয়ান ইনহ্যাবিটেন্ট চীফ শহীদুল ইসলাম। প্রায় ৫০ বছর আগের নেয়া এই প্রজেক্টের বদৌলতে ধ্বংস হওয়া পৃথিবীর মানুষেরা আজ মঙ্গলে। বহু দিন আগের সেই স্বপ্ন, সেই বন্ধু, হঠাৎ যেন শহীদুল ইসলামকে নিয়ে গেল পুরোনো সেই পৃথিবীতে।
হঠাৎ পেছন থেকে ডাক এল.........
- স্যার।
- হ্যা। কিছু বলবে?
- স্যার আজ একটা সেমিনার আছে, তার বিষয়বস্তু "মঙ্গল এর জন্ম"
আপনাকে একটু যেতে হবে সেখানে
- তোমাদের তো বলেছি এই বিষয় নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না
- কিন্তু স্যার। আমাদের ও জানতে ইচ্ছে করে এই সুন্দর লালচে মঙ্গল এ আমাদের উৎপত্তি কীভাবে হল।
- সব কিছু না জানলে ক্ষতি নেই।
- তা ঠিক স্যার। আপনি তো জানেন। মঙ্গলে কীভাবে আমাদের উৎপত্তি। আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি এ বিষয়ে জানে না।
- হ্যা। তো?
- স্যার আপনি শুধু মানুষদের এটা বলুন আপনি কীভাবে জানলেন?
- এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। আর অন্য কিছু বলার থাকলে বল।
- স্যার, তাহলে আপনি আসবেন না?
- কোথায়?
- সেমিনার??
- না......
- স্যার প্লিজ।
- তুমি আসতে পারো......
- মঙ্গলে জন্ম নেয়া এই মানুষগুলোর অনেক কৌতুহল। কীভাবে তারা এলো। এরা সবাই বাংলা বলতে জানে। কিন্তু কেউ বাঙালি নয়। মঙ্গলের শিশুরাও পৃথিবীর শিশুদের মতই দূরন্ত। মনে পড়ে ছোট বেলায় পানির রঙকে নিজেরা মনে করতেন নীল। এখন মঙ্গলের শিশুদের কাছে সেটা কমলা-লাল। কিন্তু পানি তো বর্ণহীন! শহীদুল ইসলাম নিজে নিজে হেসে উঠেন!
মঙ্গলবাসীদের মধ্যে একমাত্র শহীদুলই অনুভব করতে পারেন পৃথিবী আর মঙ্গল এর মধ্যে পার্থক্য। আর কেও জানেই না পৃথিবী নামে একটি গ্রহ কখনো ছিল! ছিল মানুষের অস্তিত্ব! শহীদুল সব জানেন। এসব তিনি উপভোগ করেন। মাঝে মাঝে মঙ্গলের মাটিতে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর মনে হয়, তিনি তাঁর জীবনে সব পেয়েছেন।আর কিছু পাওয়ার নেই।এক অপূর্ব প্রশান্তি তাঁর হৃদয়ে জেগে উঠে।
পৃথিবীর বাইরের জগতটা নিয়ে শহীদুল ইসলাম এর ছোটবেলা থেকেই ছিল অদম্য আগ্রহ। সবসময় জানতে চাইতেন বাইরের রহস্যে ঘেরা জগতটাকে। মহাকাশচারীদের অনেক ভাগ্যবান মনে হত তার! দরিদ্র এক পরিবারে সন্তান ছিলেন তিনি। মা বাবা সব সময় চাইতেন ছেলে বড় হয়ে একসময় নিজের পায়ে দাঁড়াবে, সমাজে মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু অতশত ভাবতেন না শহীদুল।
সাল ২০১৩। হঠাত করেই একদিন পত্রিকায় দেখলন মঙ্গলে মানুষ পাঠানো হচ্ছে। আগ্রহীরা আবেদন করতে পারবেন *শর্ত প্রযোজ্য *
সাল ২০১৩। হঠাত করেই একদিন পত্রিকায় দেখলন মঙ্গলে মানুষ পাঠানো হচ্ছে। আগ্রহীরা আবেদন করতে পারবেন *শর্ত প্রযোজ্য *
২৩ বছরের তরুণ শহীদুল আর একটা মিনিট ও ভাবেন না। তৎক্ষণাৎ ইন্টারনেট এ সার্চ করে সব যেনে নেন। প্রজেক্ট এর নাম মার্স ওয়ান। নেদারল্যান্ডের গবেষনা সংস্থা মার্স ওয়ানের একটি ওয়ান ওয়ে জার্নি প্রজেক্ট। যাওয়া যাবে কিন্তু ফিরে আসা যাবে না! মোট চার জনকে মঙ্গলে রেখে আসা হবে। তবে সুযোগ সুবিধা ওই প্রতিষ্ঠানই দিবে। যদি কোন ব্যক্তি ৬৮দিন সুস্থভাবে টিকে থাকতে পারেন তবে আরো অনেক মানুষ পাঠানো হবে মঙ্গলে। আর সেখানে গড়ে উঠবে মঙ্গলে মানুষের বসতি। যার প্রধান হবেন ওই ব্যক্তি। তবে শর্ত হলো, পৃথিবীর সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ থাকবে। অনেক সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নিজের জমানো টাকায় অনলাইনে ফর্ম পূরণ করলেন শফিউল। আবেদন জমা পড়ল প্রায় ২,০০,০০০। এদের মধ্যে ২৪ জন পাবেন স্পেস শিপে উঠার সুযোগ। আর মঙ্গলের মাটিতে পা রাখবেন মাত্র ৪ জন! দীর্ঘ ২ বছরের বাছাইপর্ব শেষে চূড়ান্ত হয় ১০০ ভাগ্যবানের নাম! ভাগ্যক্রমে নির্বাচিত হন শহীদুল! তারপর তাকে সংস্থায় ডাকা হয়। জমানো সব টাকা নিয়ে নেদারল্যান্ডে পাড়ি দেন তিনি। অনেক যাচাই বাছাইয়ের পর প্রথমে ১০০, তারপর ৪০, এরপর ২৪ জন আর সর্বশেষ ৪জন চূড়ান্ত হয়। বিস্ময়করভাবে শেষ ৪ জনেও স্থান পান শহীদুল! শহীদুল অনেকের সাথে কথা বলার সুযোগ পান। শেষপর্যন্ত টিকে যাওয়া এসব মানুষদের অনেকে এখনও প্রবল আগ্রহী, আবার কেউ আগ্রহী নয়, আর বাকিরা চুপ করে থাকেন সবসময়। অনাগ্রহীদের কাছে পৃথিবীটাই নাকি সবচাইতে ভালো, তারা ফিরে যেতে চান! কিন্তু ফিরে যাওয়ার জন্য ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। তরুণ শহীদুল আসলে তখন এতটাই উত্তেজিত ছিলেন যে ভাবতেই পারেন নি, অনিশ্চিত সেই যাত্রা কতটা কষ্টের হবে! দীর্সৃঘষ্টির শুরু থেকে যে জমিতে কিছুই হয় নি সেখানে তাদের থাকতে হবে!
সব অনিশ্চয়তা সাথে নিয়ে ২০২৪ সালে ৩৪ বছর বয়সে যাত্রা শুরু করেন শহীদুল ইসলাম। প্রায় ২৫০ দিনের যাত্রা শেষে মঙ্গলের মাটিতে পা রাখেন তারা ৪ জন। শহীদুলের অপর ৩ সঙ্গী রবার্ট মুর, আলবার্ট জোসেফ, উইলি হেনিং।একজন রাশিয়ান, অপরজন ইংরেজ আর তৃতীয় জন জার্মান। শহীদুল মঙ্গলে এসেছিলেন তার স্বপ্ন পূরণ করতে, রবার্ট এসেছিলেন পৃথিবীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে, কারণ পৃথিবীর উপর তার অনেক ক্ষোভ। আর উইলি একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। তিনি মঙ্গল এ উদ্ভিদ ফলাতে এসেছেন।
তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ঘর, পানি, খাবারসহ সব বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা ছিল। অক্সিজেন এর ট্যাংকও ছিল পর্যাপ্ত। এদের মধ্যে একমাত্র শহীদুল আর জোসেফ এর বয়স অল্প।বয়সে কাছাকাছি হলেও তাদের মধ্যে কিছুতেই কোন মিল ছিল না। জোসেফ তার জীবনে সব পেয়েছিল যেমন ঠিক তেমন সব হারিয়েছিল। অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিল জোসেফ। মা বাবা যেন থেকেও নেই। জোসেফ এর যখন ৭ বছর বয়স তখন তার মা বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কোনকিছুর অভাব না থাকলেও কোথাও একটা কমতি থেকেই যেত। জোসেফ বুঝতোই না সে কি চাইত। মা-বাবা কারোর কাছে কিছু চাইলে তারা কখনো না বলতো না। বন্ধুর সংখ্যা খুব কম। একটা মেয়েবন্ধু ছিল সেও একসময় তাকে ছেড়ে চলে যায়। সব কিছুর উপর ক্লান্ত জোসেফ এসবকে পিছনে ফেলে নতুন ভাবে কিছু শুরু করতে চেয়েছিল। সে ভিড়ের মাঝে একা থাকার চেয়ে সত্যিকার অর্থে একা থাকতে চেয়েছিল। জোসেফ ছিল অদ্ভুত রকমের শান্ত। ৪ জনের বোঝাপড়াটা ভালোই হত। সবাই মোটামুটি ইংরেজি জানতো। তবে শহীদুল চেয়েছিল মঙ্গলে সে বাংলার জন্ম দিবে। তবে কাওকে তা বলতো না।
উইলি পৃথিবী থেকে অনেক ছোট ছোট গাছ নিয়ে এসেছিল। কি সব গবেষণা করে সে শুধু একরকম গাছই লাগাতো। বাকি গুলো যত্ন করে রেখে দিতো। সে বলতো যদি হয় এই গাছ গুলোই বড় হবে। রবার্ট পৃথিবীকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করতো সবসময়। উইলি তাকে বলত, "জানো? তোমার পৃথিবীকে ধ্বংস করার প্রয়োজন নেই। পৃথিবী এমনিতেই অসুস্থ, যেকোন সময় হিট স্ট্রোক করে নিজেই মরে যাবে। আসো আমরা মঙ্গল কে গড়ি। যেখানে গাছকে বাঁচাবো। মঙ্গল এর অবস্থা পৃথিবীর মতো হতে দিব না কখনোই।" আর জোসেফ কিছুই বলত না সারাদিন আপন মনে কি সব ভাবত আর বই পড়ত খুব।
শহীদুল অবাক হয়ে তাদেরকে দেখতো।
বাঙালিরা শুধু স্বপ্ন দেখতে জানে না, স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতেও জানে। গাছের কথা শহীদুল এর মাথায় কখনোই আসতো না। অবশ্য সে যদি গাছ লাগাতো তবে তা এই শুষ্ক মাটিতে কীভাবে লাগাতো তাও জানতো না। নাহ্ মঙ্গলে আসলে একমাস কাটাতে তাদের জন্য কোন ব্যাপারই ছিল না। প্রথমদিকে অসম্ভব মনে হলেও একসময় উইলি কৃত্তিম পদ্ধতিতে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী করে গাছগুলো বড় করতে সক্ষম হয়। শহীদুল শুধু হা করে দেখত উইলির কাজকারবার। তাকে উইলি বলেছিল,"এগুলো হল এমন গাছ যেগুলো প্রতিকুল পরিবেশেও বাঁচতে পারে।আমরা সাক্সেস্ফুল।আসো বাকিগুলো ও লাগিয়ে নি।"
দেখতে দেখতে দুইমাস ফুরিয়ে যায়। রবার্ট ও উইলি শেষদিকে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে। সবার মধ্যে শহীদুলই একমাত্র সুস্থভাবে টিকে থাকে। তারপর পৃথিবী থেকেও ধীরে ধীরে মানুষ পাঠানো হয়। মোট এসে পৌছায় ৫০ জনের একটি দল। ২৫ জন পুরুষ , ২৫ জন মহিলা। উইলি আর রবার্ট এর বয়স ছিল প্রায় ৬০-৭০ এর কাছাকাছি, শেষদিকে জোসেফ হয়ে যায় কিছুটা পাগলাটে। আর শহীদুলের তখন ৩৪। তাই তারা দুই জন ভেবেচিন্তে শহীদুলকে চীফ করার সিদ্ধান্ত নেন। কারন উইলি শুধু গবেষণা করবে আর রবার্ট এর এসবে আগ্রহ নেই। শহীদুলের তখন মনে পড়ে যায় দেশের কথা। বাবা মা একসময় খুব চাইতেন তাদের ছেলে নাম করুক। দেশের জন্য কিছু করুক। শহীদুলের হঠাত মনে পড়ে তাদের কথা, নিজের ছোট্ট দেশটার নিরীহ সাধাসিধে মানুষগুলোর কথা। হঠাতই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন তিনি। তিনি মঙ্গলে বাংলার বসতি করবেন! সিদ্ধান্তটা জানান উইলি আর রবার্টকে। তারা প্রথমে ভাবেন মজা করছে শহীদুল। কিন্তু একসময় বুঝতে পারেন মজা করার মানুষ সে নয়। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হয়। মঙ্গলের প্রথম জন্ম নেয়া শিশুদের বাংলা শেখাবেন শহীদুল। তাদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হবে বাংলা স্কুল। নিজের দেশকে দেয়ার জন্য আর কিছু যে নেই তার! দেশটাকেই বাঁচিয়ে রাখবেন তিনি! সেটা যেখানেই হোক!! ধীরে ধীরে নিজের স্বপ্নের দিকে পা বাড়ান শহীদুল। নিজের দেশকে বাঁচিয়ে রাখার স্বপ্ন!
মঙ্গল বাসীরা কখনো জানবে না পৃথিবী নামক একটা গ্রহে একসময় প্রাণের অস্তিত্ব ছিল। কেননা, পৃথিবী শহীদুলদের পাঠানোর কয়েক বছর পরেই ধ্বংস হয়ে যায় বিশাল এক মহামারীতে। অতিরিক্ত উত্তাপ, অজানা রোগ, হঠাত ভূমিকম্প, বন্যা, পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা অনেক প্রভাবকই ছিল পৃথিবী ধবংস হওয়ার পেছনে। উইলির ভবিষ্যতবানী সত্যি হয়েছিল!
শহীদুল মঙ্গল এ একা কখনোই বাঁচতে পারতো না। তাই সে উইলি আর রবার্ট এর প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকবে। সবার সিদ্ধান্তে সবকিছু গোপন রাখা হয় মঙ্গলের নতুন জন্ম নেয়াদের কাছে।
শহীদুল এর বয়স এখন ৭৫ বছর। তিনি তার স্বপ্নের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। স্কুলের সবকিছু বাংলায়। বাংলা গানও শেখানো হয় তাদের। মাঝে মাঝে স্কুলের বারান্দায় হাঁটতে গিয়ে শহীদুল প্রায়ই শোনেন ,"আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,"
শহীদুল এর চোখের কোনে পানির ফোঁটা দেখা দেয়।নাহ্ কেউ লক্ষ্য করে না। হ্যা শহীদুল ইসলাম সফল হয়েছেন! তিনি সফল হয়েছেন মঙ্গলের মাটিতে বাংলার বীজ বুনতে!!
মঙ্গলের লালচে মাটিতে খেলা করছে দুই শিশু। বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাত একজন বলে উঠলো,
-বলতো মঙ্গল কার?
-মঙ্গল?......মঙ্গল সবার!
গল্পটা ভালো হইছে।
ReplyDeleteবাংলাকে নিয়ে সবসময় আমাদের একটা ইমোশান কাজ করে ভালোবাসি বলে।
চালিয়ে যাও। আরো ভালো কিছু আশা করা যায় :) ।