পরম্পরা ( পর্ব -১ )
অন্তরাদিদি মরে গেলেন...... শেষকালে
তিনি ভীষন কষ্টই পেয়েছিলেন বোধহয়। পাড়াপড়শিরা সবাই শোকাহত , নাকি শোকাহত হওয়ার অভিনয় করছে? বোঝা যাচ্ছে না। তবে যাই হোক সবাই
কেমন জানি চুপচাপ আর মহিলারা সবাই জোরে জোরে কাঁদছে। এই কান্নায় সুর ও আছে কথাও
আছে। অদ্ভুত এক কান্না! সব আছে শুধু অনুভূতিটাই নেই!
অভি বসে আছে অনেক দূরে। এখান
থেকে অন্তরাদিদির নিস্তেজ দেহটাকে দেখা যাচ্ছে না। তার বারবার মনে হতে লাগলো এটা
কেন হল...? অন্তরাদিদির
মৃত্যুতে সে ও যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু তা অন্য কারনে। এরই মধ্যে অভি অনেককে
বলতে শুনেছে কেও মারা গেলে কাঁদতে হয়। এতে নাকি মৃত আত্মা শান্তি পায়! যে কাঁদে না তাকে
নাকি ওই মানুষটার ভূতে ধরে! অভি তাই চায়। তাই বোধহয় আজ সে কাঁদছে না। সে তার
আশেপাশের মানুষগুলোকে অবাক হয়ে দেখছে। যে মানুষ গুলো এত বছর এত কাল অন্তরাদিদির
সাথে কথা বলা তো দূরে থাক খোঁজ খবর পর্যন্ত নেয়নি তারাও আজ কাঁদছে। অনেকে আবার
অন্তরাদিদির নামে সুনাম গাইছে। বড়ই অদ্ভুত এসব মানুষ!
অন্তরাদিদিকে জীবিত থাকা অবস্থায়
তেমন কেউ পছন্দ করতো না। মোটামুটি এক ঘরে হয়েই থাকতো অন্তরাদিদি। যদিও
সিদ্ধান্তটা অন্তরাদিদি নিজেই নিয়েছিলেন। গ্রামবাসীর সাথে তার কথার মিল ছিল না।
নানা কারনে সে একাই থাকতো। অভি অন্তরাদিদিকে ভীষন ভালোবাসতো। অভির তখন মনে হত
অন্তরাদিদি আধুনিক খুব। যা প্রয়োজন নয় তা নিয়ে ভাবা, পরের বদনাম করা, ছোট জিনিসকে বড় করে দেখা, বড় জিনিসের কথা ভুল যাওয়া,লোক দেখানো স্বভাব, অন্যের সমালোচনা করা....... নাহ এসবের একটিও অন্তরাদিদি করতেন না।
অন্তরা দিদিকে নির্দ্বিধায় সব কিছু বলা যায়। অন্তরা দিদি সব বুঝে। অন্তরাদিদিকে
যা বলা যায় তা অভি তার মা–বাবা কিংবা কোন বন্ধুকেও বলতে পারতো না। অন্তরাদিদি অভির কাছে সবসময়
একজন আদর্শ। অভির ভালো লাগতো সে যতক্ষন অন্তরা দিদির কাছে থাকতো। অন্তরাদিদি ও
অভিকে খুব পছন্দ করতো। অনেক আদর করতো।
শেষকালে অভিই অন্তরাদিদির দেখা শোনা
করেছিল। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে অন্তরা দিদির খুব কাশি হয়েছিল। তারা এমন একটি গ্রামে
থাকতো যেখানে কোন ডাক্তার নেই। যা ছিল সব হাতুড়ে ডাক্তার আর শিকড় বাকড় দেওয়া কিছু
লোক। কিন্তু অভি জানতো কাশিতে বাসক পাতা খেলে ভালো হয়। সে প্রতিদিন বাসক পাতা এনে
দিত। কিন্তু কাশিটা দিদির কমে নি। বরং দিনদিন বেড়েই গেছে। এরপর একদিন দিদি রক্তবমি
করে মারা যান। অভি অবশ্য পাশেই ছিল। খবরটা কেমন করে জানি সবাই আলোর বেগে জেনে
যায়। নাহ অভি কাওকে খবর দেয় নি।
দিদির জন্যে এতো কিছু করা সেই অভি আজ
দিদির পাশে নেই দূরে বসে আছে। কোথায়? সে তো কাঁদছে না! গ্রামবাসীরা অবাক না হয়ে পারলো না। এ কেমন ছেলে রে
বাবা!
অভিকে গ্রামবাসীরা মোটামুটি সবাই খুব
ভালোবাসে। ছেলেটা ভদ্র, গুরুজনদের ভক্তি করে, পড়াশোনার মাথাও ভালো। শুধু তার অন্তরার সাথে মেলামেশা করাটা কারোর
পছন্দ হত না। কয়েকবার মানা করা হলেও অভি তাদের কথা পাত্তা দেয় নি। তারপর অবশ্য
একসময় সবাই নিজ থেকেই চুপ হয়ে গিয়েছিল।
অভি এখনো বসে আছে। আর ভাবছে কত কথাই
না বাকি ছিল। দিদিটা এত তাড়াতাড়ি চলে গেল কেন? কেন তাকে ঠকালো? দিদিটা একটা শয়তান! বিশ্বাসঘাতক! না সে কাঁদবে না, কাঁদলে যদি দিদি ভূত হয়ে না আসে??
অভি এমনিতে বড্ড লাজুক হলেও দিদির
সাথে তার কোন লজ্জা নেই। কাওকে কিছু বলতে না পারলে সে সব কিছু দিদিকে বলতো। দিদির
কাছে সব সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়!
গ্রামের মধ্যে মেয়েদের বড় হতে হয়
অনেক বাঁধার ভেতর দিয়ে। ঘর থেকে কাজ ছাড়া বের হওয়া বারণ সবার। আর বয়স না হতেই এদের
বেশিরভাগকেই বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়। অন্তরা দিদি এসব মেনে নেন নি কখনো তাই তাকে
থাকতে হয়েছে একঘরে হয়ে।
এমন বাঁধার মাঝে ছেলে মেয়েদের দেখা
হত খুব কম। কিন্তু অভি ওই দক্ষিন দিকের বটগাছটার পাশে যে কয়টা ঘর আছে তার মধ্যে
পাঁচ নাম্বার ঘরটায় থাকা মেয়েটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল! মেয়েটার নাম মিতা। এই মেয়ে
একদমই ঘর থেকে বের হয় না। অভি তাকে ঘরেই দেখেছে। একদিন সরস্বতী পূজার চাঁদা চাইতে
গেলে তার সামনে হঠাত এসে যায় মেয়েটা। গ্রামে অভির ভালোই সুনাম আছে। আর দেখতেও বেশ
ভালো, অন্য মেয়েরাও
তার সাথে কথা বলতে চায়। আর অভির সাথে কথা বললে বাড়িতে কারোর বাবা মা তাদের বকা দেয়
না। তাই সবাই অভির সাথে ভাব জমাতে চায়। কিন্তু এই মেয়েটা অভির সামনে তেমন কোন আচরন
ই করলো না! কেমন স্বাভাবিক! আর তার বাবাকে ডেকেই ভেতরের ঘরে ঢুকে পড়লো। অভি সেদিন
মনে মনে মেয়েটাকে যাচ্ছে তাই বলেছে। কি ভাবে ও নিজেকে?... হ্যা? কিন্তু যতই গালি দেয় ততই যেন সে মেয়েটার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল।
কিছু একটা তো ছিল মেয়েটার মাঝে। তার নির্লিপ্ত ,ভাবলেশহীন চাহনি......বারবার মেয়েটার কথা মনে হতে থাকে অভির।
সে সবকথা অন্তরা দিদিকে বলে। সব শুনে
অন্তরাদিদি হাসতে হাসতে বলেন, “হ্যা রে অভি, তুই তো প্রেমে পড়েছিস,উঠতে পারবি তো?” অভি খানিকটা লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে উঠে। দিদিকে বলে, “কি করবো তাহলে দিদি?” দিদি অভিকে সেবার কথা দিয়েছিল সে
অভিকে সাহায্য করবে। অভির খুশি আর দেখে কে! তারপর দিদির অসুখ করে। কিন্তু এরপরও
দিদি অভিকে বলতো কিভাবে কি করতে হবে। অভি সব মন দিয়ে শুনতো আর দিদির সেবা করতো। এই
দিদিই যে একদিন তাকে এভাবে অসহায় ভাবে ফেলে রেখে চলে যাবে তা অভি ভাবে নি। আজ বসে
বসে এসব কথা ভাবছে অভি...
অন্তরাদিদির মৃত্যুর ৬ মাস হয়ে
গেছে.......................................(চলবে)
*পরের পর্ব - পরম্পরা (পর্ব- ২)
*পরের পর্ব - পরম্পরা (পর্ব- ২)
Ending এর কারণে পরের পর্বটা পড়ার আগ্রহ থাকল।
ReplyDelete