মানবতার পতাকাবাহী এক মহানায়ক - নেলসন ম্যান্ডেলা
১৯৯৫ সালের কথা।
সেইবার রাগবি বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ ছিল সাউথ আফ্রিকা। ওই সময়টায় আফ্রিকার বর্ণবাদ
ছিল চোখে পড়ার মত। আর রাগবি টিমের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই শ্বেতাঙ্গ। তাই কৃষ্ণাঙ্গ
লোকেরা ওই দলকে ঘৃণার চোখে দেখত। কিন্তু নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন ব্যাতিক্রম।
তিনি সবসময়ই কৃষ্ণাঙ্গদের উৎসাহিত করতেন দলকে সমর্থন দেওয়ার জন্য। দেখতে দেখতে
ফাইনালে পৌছে যায় সাউথ আফ্রিকা। প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড।
ফাইনাল দেখতে মাঠে
হাজির হয় ৬২০০০ দর্শক। তাদের বেশিরভাগই শ্বেতাঙ্গ। আর একজন ছিলেন যিনি বর্ণবাদের
তোয়াক্কা না করে হাজির হন স্টেডিয়ামে। তাঁর পরনে ছিল নিজ দলের অধিনায়ক ফ্রান্সচয়িস
পিয়েনার জার্সি।ওই সময়ের প্রেক্ষিতে এটা ছিল অভূতপূর্ব একটা ঘটনা। মাঠে আসা হাজার
হাজার শ্বেতাঙ্গ দর্শক বাধ্য হয় তাকে সম্মান জানাতে। তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা। পুরো
স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানায় এই মহান নেতাকে। এমনকি এই ঘটনা ছুঁয়ে যায়
খেলোয়াড়দেরও। ম্যাচ শেষে এক প্রশ্নের জবাবে অধিনায়ক ফ্রান্সচয়িস পিয়েনা জানায় – “ ম্যাচে শুধু ৬২০০০ দর্শকই আমাদের পাশে ছিল না , ছিল
৪৩ মিলিয়ন সাউথ আফ্রিকান "
এভাবে পুরো জীবনে
বারবার তাঁর প্রগতিশীল নেতৃত্বের ছাপ রেখে গেছেন এই মহান নেতা । দেখিয়েছেন দেশের
প্রতি ভালোবাসা , দেখিয়েছেন মানুষের প্রতি ভালোবাসা ।
পুরো নাম নেলসন
রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলা, অনেকে ভালোবেসে তাঁকে ডাকেন মাদিবা! সারা জীবন
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া এই মানুষটি সবাইকে শিখিয়েছেন কিভাবে শরীরের রঙ ছাড়া
মানুষের ভেতরটাকে দেখতে হয়।
১৯১৮ সালের ১৮ই
জুলাই দক্ষিন আফ্রিকার কেপ প্রদেশের ট্রান্সকেই অঞ্চলে জন্ম নেন ম্যান্ডেলা। তাঁর
গ্রামের নাম ছিল মজেভো। ম্যান্ডেলার বাবা গাদলা হেনরি মপাকানইসা ছিলেন নিজ গ্রামের
মোড়ল। শৈশবে ম্যান্ডেলার ডাক নাম "রোলিহ্লাহ্লা"র অর্থ হলো "গাছের
ডাল ভাঙে যে", অর্থাৎ দুষ্ট ছেলে। স্কুলে পড়ার সময়ে তাঁর শিক্ষিকা ম্দিঙ্গানে
তাঁর ইংরেজি নাম রাখেন "নেলসন"।
বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়া অবস্থায় ম্যান্ডেলা জড়িয়ে পড়েন নানা ধরনের আন্দোলনে। ১৯৪৮ সালে দক্ষিন
আফ্রিকায় ন্যাশনাল পার্টির বিজয় লাভের পর বর্ণবাদ যখন মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়ায় তখনই
এর প্রতিবাদে রুখে দাড়ান নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৫২ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের
হয়ে শুরু করেন বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন। যার দায়ে দক্ষিণ আফ্রিকার
বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার ১৯৫৬ সালের ৫ই ডিসেম্বর তারিখে ম্যান্ডেলা সহ ১৫০ জন
বর্ণবাদ বিরোধী কর্মীকে দেশদ্রোহিতার মামলায় গ্রেপ্তার করে। প্রায় ৫ বছর আদালতে
মামলা চলার পর তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন।
প্রথমদিকে গান্ধীর
অহিংস আন্দোলনের বিশ্বাসী হলেও ৬১ সালের ম্যান্ডেলা এএনসির সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন
উমখোন্তো উই সিযওয়ে (অর্থাৎ "দেশের বল্লম", সংক্ষিপ্ত নাম MK) এর
নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এই আন্দোলনকে ম্যান্ডেলা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তার শেষ চেষ্টা
হিসেবে অভিহিত করেন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৬২ সালের ৫ই আগস্ট ম্যান্ডেলা গ্রেপ্তার হন।
এরপর দীর্ঘ দুই বছরের মামলা শেষে ১৯৬৪ সালের ১২ই জুন ম্যান্ডেলাকে যাবজ্জীবন
কারাদন্ড দেয় আদালত। যার মেয়াদ কাল ছিল প্রায় ২৭ বছর!১৯৯০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি
ভিক্টর ভার্সটার কারাগার থেকে ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেয়া হয়।
১৮ বছর রবেন
দ্বীপের নিভৃত কারাগারে কারাবাসের পরও যিনি নিজের অদম্য সংকল্প থেকে এতটুকু ও টলেন
নি, সেই মহান পথিকৃতের আজ জন্মদিন! শুভ জন্মদিন নেলসন ম্যান্ডেলা! শুভ
জন্মদিন মাদিবা! জন্মদিনে তার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা আর অকুন্ঠ ভালোবাসা ।
তার রেখে যাওয়া আদর্শে সুন্দর হোক পৃথিবীর পথচলা , মুছে যাক বর্ণবাদের
কালো অধ্যায় । ভেদাভেদবিহীন এক সমাজের স্বপ্ন দেখা এই মহনায়কের আদর্শ বেঁচে
থাকুক সারা বিশ্বে।
Comments
Post a Comment