পরম্পরা (পর্ব -২)
এরপর........................
আজ
অভি শহরে যাবে। গত মাসে তার মেট্রিকের রেজাল্ট হয়েছে। অভি খুব ভালো করেছে! অবশ্য
করবেই বা না কেন? গ্রামের একমাত্র স্কুলটাতে সেই সবসময়
ফার্স্ট বয়! অন্য ছেলেমেয়েদের তেমন একটা পড়ায় মনোযোগ ছিল না। কিন্তু অভির অনেক
মনোযোগ। তাই তাকে নিয়ে সবার স্বপ্নটাও অনেক! গ্রামবাসীর পরামর্শে অভির মা-বাবা
সিদ্ধান্ত নেয় অভিকে তারা শহরে পাঠাবে।
নৌকা
পার হয়ে একটু হেঁটেই বাস স্ট্যান্ড। তারপর ৭-৮
ঘন্টার লম্বা একটা পথ, এরপর
শহর। অভি চেয়েছিল আজ অন্তত মিতাকে যেন সে দেখতে পায়, না মিতা সেদিন ও আসে নি। দিদি মারা গেছে ৬ মাস হয়ে গেল। অভি একটা
একটা দিন গুনেছে। দিদিকে অভি একটা দিনের জন্য ও ভুলে নি। আচ্ছা......আজ দিদি থাকলে
কেমন হত? নিশ্চই অভিকে নিয়ে অনেক গর্ব করত আবার
মন খারাপও করত। মনের অজান্তে চোখের কোন ভিজে উঠে অভির। বাসের জানালা দিয়ে মুখটা
বের করে দেয় অভি। অনেক বাতাস...... যাক চোখটা শুকিয়ে! এত বড় ছেলের চোখে পানি ভাল
দেখায় না!
কলেজে
ভর্তির প্রথম দিন অভির বাবা ভর্তির সমস্ত কাজকর্ম সেরে আবার চলে যান। এরপর এই
বিশাল শহরে অভি সম্পূর্ণ একা। প্রথম প্রথম বাড়ির জন্য মন খারাপ থাকলেও ধীরে ধীরে
দুই এক দিনের মাঝে তার অনেক বন্ধু জুটে যায়। কলেজেও অভির ফলাফল ভাল হতে থাকে।
শহরের ছেলেরা পর্যন্ত তার কাছে পড়া বুঝে নেয়। স্যাররাও অভিকে অনেক পছন্দ করে। বাড়ি
থেকে প্রতি মাসে চিঠি আসতো সাথে টাকা।
এভাবে দেখতে দেখতে অভি আইএ পাশ করে ফেললো। অবশেষে ২ বছর পর অভি তার গ্রামে ফিরল। ২
বছর গ্রাম ছেড়ে থাকলেও সে তার গ্রামকে ভুলে যায়নি। সবার কথাই মনে পড়ত তার......
তবে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ত অন্তরাদিদির কথা আর মিতা!
গ্রামের
সবাই অভিকে দেখতে এসেছে। কিন্তু মিতা আসে নি। অভির হঠাৎ ভয় হতে লাগলো, আচ্ছা....মিতার বিয়ে হয়ে যায় নি তো? সে তো কয়েকজনকে জিজ্ঞেসই করে বসলো যে
গ্রামে ২ বছরের মধ্যে কারো বিয়ে হয়েছে কিনা? একজন বললো একটা মেয়ের বিয়ে গত জুলাই মাসের ৯ তারিখ হয়েছে। কিন্তু
না...... সে মিতা নয়! অভি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল!
গ্রামবাসীরা
এবার অভির মা-বাবা কে বলল অভি যেন ডাক্তার হয়, তাহলে সবার অনেক সুবিধা হবে। অভির মা-বাবার ও অমত নেই। আর অভিও তাই চায়।
তবে গ্রামবাসীরা অভির কাছে শুধু একটাই আবদার করলো, অভি যেন ডাক্তারী পাশ করে গ্রামে ফিরে আসে, এই গ্রামটায় যেন বিনা চিকিৎসায় আর কেও
মারা না যায়। অভিও কিন্তু শহরে থাকতে চায় না। তাই এতেও তার আপত্তি নেই।
এবার
শহরে গেলে ৪-৫ বছরের আগে সে আসতে পারবে না। তাই সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে সে আশীর্বাদ নিয়ে নিল। দক্ষিন দিকের বট গাছটার
পাশের ওই ৫ নাম্বার বাড়িটাতেও গেল। সেদিনের মত আজকে কোন মেয়ে দরজা খুলে দিল না।
অভির খুব জানতে ইচ্ছে করছিল কেমন আছে মিতা। একবার যদি দেখা হত! মিতার বাড়ির বড় সবাইকে
নমস্কার করা হলেও সে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ছিল। হয়ত এই বুঝি মিতা এল......... না মিতা
আসে নি! অভি চলে এল।
হাঁটতে
হাঁটতে এবার অভি এল শ্মশানে। এখানেই অন্তরা দিদিকে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। আগে এখানে
কখনো আসেনি অভি। একবারের জন্যও কাঁদে নি। আজ এল। এখানে একটা নাম লেখা আছে “অন্তরা ভট্টাচার্য, জন্ম সাল -১৯০১, মৃত্যু সাল – ১৯৩১। অভি এসে বসলো দিদির এই শ্মশানের
সামনে। আজ সে কিছুতেই নিজের চোখের জল আঁটকে রাখতে পারলো না। কি অবাক কান্ড অভি
ছোটদের মত বড় বড় করে কাঁদছে আজ!
“দিদি তুমি এমন কেন করলে? জানো,দিদি আমি মেট্রিক আর আই.এ পাশ করেছি। দিদি জানো তোমার অভি এবার ডাক্তারী
পড়বে। তারপর ডাক্তার হবে। দিদি তুমি তো আগে আমি ফার্স্ট হলে পিঠা বানিয়ে রাখতে, আজ আমার এতগুলো পিঠা জমা রেখে দিয়েছো।
তোমার বুঝি কষ্ট হয় না??দিদি তোমার ভুত টাও তো এল না। তুমিও
এলে না। মিতাও আমাকে দেখতে এল না। তুমি না বলেছিলে মিতার সাথে আমার বিয়ে দিবে? না তুমি মিথ্যাবাদী। তুমি আমাকে
ভালবাসো না দিদি! আমাকে একা রেখে গেলে কেন ? কেন? কেন?”
হঠাত
একটা কুকুর ডেকে উঠলো।অভি জেগে উঠলো...... কাঁদতে কাঁদতে কখন যে সে বেঞ্চের উপর
ঘুমিয়ে পড়েছিল টেরও পায় নি। মুখে হাত পড়তেই সে বুঝতে পারলো সে কেঁদেছিল। আশেপাশের
কেউ তাকে দেখে নি তো? না কেউ নেই। অভি তার দিদির শ্মশানে
নমস্কার করে সেখান থেকে চলে এল।
অভি
আবার শহরে ফিরে যাবে। এবারও সবাই এল। অভি জানতো মিতা আসবে না। মিতা সত্যিই আসে নি।
অভি চলে এল সেই আগের শহরে। মেডিকেলে ভর্তির পর কলেজের হোস্টেল ছেড়ে হলে উঠে সে।
কলেজের হলটা ও অভির অনেক পছন্দ হয়েছে। নতুন বন্ধু ও জুটেছে তার। এবার শুধু
পড়ালেখাটা করে ডাক্তারী পাশ করতে পারলেই হয়।
মেডিকেলের
প্রথম বর্ষের ছাত্র অভি। হলের দোতালার রুমটাতে অভি আর তার বন্ধুর দিন ভালই কেটে
যায়, দুই বন্ধু মিলে একটা কঙ্কালও কিনেছে।
কিন্তু এই পড়ালেখায় মজা নেই, সারাদিন
শুধু পড়তেই হয়। বাড়ির খোঁজ সে আর বিশেষ নেয় নি। তবুও প্রতি মাসে ডাক যোগে তার জন্য
একটা করে চিঠি আসে বাড়ি থেকে আর টাকা। অভি কোনমাসে জবাব দেয় তো কোন মাসে দেয় না।
আজকাল কেমন যেন হয়ে গেছে সে! সারাদিন পড়ে! এখন সে অন্তরা দিদির কথাও ভাবে না, মিতার কথাও না। মানুষের কষ্ট গুলো আসলে
কাটা পেঁয়াজের মত। আশেপাশে থাকলেই চোখে জল এসে যায়। হয়তো আবার গ্রামের কথা কোন এক
কাক ডাকা ভোরে অভির মনে পড়বে। হয়তো মনে পড়বে অন্তরা দিদির ভালোবাসা কিংবা মিতার
সেই নির্লিপ্ত মুখখানি। কিন্তু না! সময় বড় নিষ্ঠুর। সব কিছুই পরম যত্নে ব্যস্ততার
আড়ালে মানুষকে ভুলিয়ে দেয়। সময়ই নিয়ে আসে নতুন নতুন মুখ, দূরে সরিয়ে দেয় আগের আপন মানুষগুলোকে।
Wow.. keep it up
ReplyDeletethanku dada...
ReplyDelete"মানুষের কষ্ট গুলো আসলে কাটা পেঁয়াজের মত। আশেপাশে থাকলেই চোখে জল এসে যায়।"
ReplyDeleteকথাটা চমৎকার।
গল্পটা জমে উঠতাছে,আরেকটা পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
ReplyDelete