তাজউদ্দীন আহমেদ - 'মুছে যাক আমার নাম, তবু বেঁচে থাক বাংলাদেশ'
![]() |
তাজউদ্দীন আহমেদ |
সাল ১৯৭১। স্থান ৮ নম্বর থিয়েটার রোড,প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের কার্যালয়।
সেখানটারই একটা চেয়ারে বসে আছেন খুব সাদামাটা পোশাকের এক সুদর্শন ব্যক্তি, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা।
একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে তাঁকে, কারণ কিছুক্ষ্ণ আগেই খবর
পেয়েছেন, একমাত্র ছেলেটা খুব অসুস্থ, দেখতে
যাওয়াটা জরুরি। পরক্ষণেই তার চোখে ভেসে ওঠে, সারা দেশে যখন
মুক্তিযোদ্ধারা খেয়ে না খেয়ে, পরিবার পরিজন ফেলে রণাঙ্গনে
দেশের জন্যে লড়ছে, আর তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে আরামের জীবন কাটাবেন, পরিবারকে সময় দেবেন, তা তো হতে পারে না। অতএব, রয়ে গেলেন সেখানেই।
শুধু তাই নয়, যুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি তাঁর
অফিসঘরেই কাটিয়ে দেন,শুধুমাত্র দেশের স্বাধীনতার কথা চিন্তা
করে। এমনকি ইদের দিনও তিনি ছুটেছেন দূর দূরান্তের রণাঙ্গনে,মুক্তির
বার্তা নিয়ে।
![]() |
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমেদ |
বলছিলাম বাঙ্গালী জাতির এক মহান কান্ডারী, তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের
কথা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা আসলেই যে কটি নাম সবার আগে উঠে আসে, তাঁর মধ্যে তাজউদ্দিন আহমেদ
অন্যতম। দেশই ছিল তাঁর কাছে প্রথম ও শেষ কথা। দেশের ওই করুণ সময়ে পুরো জাতির
ভার নিজে একাই বহন করেছিলেন, রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মত
গুরুদায়িত্বের সম্মান। যুদ্ধকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সারা দেশবাসীকে
ঐক্যবদ্ধ রাখা, সামরিক, রাজনৈতিক,কূটনৈতিক দিক থেকে সারা বিশ্ববাসীকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত করা,
রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যোগানো প্রতিটি কাজই তিনি করেছেন
অসীম দক্ষতায়, যার ফলশ্রুতিতে আজ আমাদের এ দেশ।
![]() |
তাজউদ্দীন আহমেদ ও স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন |
এদেশের স্বাধীনতার পেছনে যদি বঙ্গবন্ধুর পর কারও নাম বলতে হয়, তবে প্রথমেই আসে তাজউদ্দীনের
কথা। প্রচন্ড মেধাবী এ মানুষটি ছিলেন সুস্থির প্রকৃতির, প্রচন্ড
আত্মবিশ্বাসী। তাঁর আত্মবিশ্বাসের একটা নমুনা দেয়া যাক। তখন প্রবাসী সরকারের
কার্যালয় ছিল ভারতের মাটিতে। ভারতের সাথে এদেশের সময় ব্যবধান প্রায় ৩০ মিনিটের মত।
কিন্তু তাজউদ্দিন কখনই তাঁর ঘড়ির সময় ভারতীয় সময়ের সাথে মিলিয়ে ফেলেননি,
দেশের সময়টাই ঘড়িতে সেট করে রেখেছিলেন, হয়ত
দেশের সময়টার সাথেই তিনি ক্ষণ গুণতেন দেশ স্বাধীন হবার।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কাছে তাজউদ্দীন আহমেদ ছিলেন এক আতঙ্কের নাম। তাঁর সুস্থির চিন্তাভাবনা
তখনকার শাসকদের মাঝে সৃষ্টি করত ত্রাসের। পাকিস্তানী উচ্চ পর্যায়ে তাঁকে নিয়ে একটি
কথা প্রচলিত ছিল- যন্ত্র ছোট হলেও ক্ষমতা বিশাল, একেবারে
জাপানিদের বস! তাঁকে নিয়েই একবার মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক
চলাকালে ভুট্টো উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন-
‘আলোচনায় আমি মুজিবকে ভয় পাই না। মুজিবকে সহজেই
ধরাশায়ী করা যাবে, কিন্তু তাঁর পেছনে যে লোকটা ফাইল হাতে বসে ছিল, সেই
তাজউদ্দিন,তাঁকে সামলাতে হবে। আমি বলে রাখলাম, এই, ভয়ংকর, Notorious তাজউদ্দীনই
হবে আমাদের মাথা ব্যাথার কারণ’।
পরবর্তীতে হয়েছেও তাই, তাঁর বুদ্ধির উপর ভর করেই হয়েছে দেশ স্বাধীনের সব পরিকল্পনা, আমরা পেয়েছি একটা স্বাধীন দেশ।
তাজউদ্দীন এমন একজন নেতা, যিনি নিজেকে সবসময় রেখেছেন সাধারণ মানুষের কাতারে।
যুদ্ধের পর তাজউদ্দীন গিয়েছিলেন নিজ এলাকায়, নিজের মানুষদের
দেখতে, বলছিলেন কিভাবে শিশু বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে তার
কথা। তখন অনেকেই বলল, আর চিন্তা কি, তাজউদ্দিনের
ভাইয়ের পোড়া ভিটায় নতুন বাড়ি উঠবে। এ কথা শুনে নেতা বললেন-
‘আমি
শুধু এই এলাকার মন্ত্রী না, আমি সমস্ত বাংলাদেশের,
যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের ঠাঁই হবে না, ততদিন এই পোড়া ভিটায় বাড়ি উঠবে না।’
(তথ্যসূত্রঃ আমার ছেলেবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন
আহমদ - সিমিন হোসেন রিমি)
প্রিয় দল আওয়ামী লীগ আর প্রিয় নেতা শেখ মুজিবের প্রতি তাজউদ্দীনের আনুগত্য ছিল
অসীম। ১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর ভারত যখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল, তাজউদ্দীন বলে উঠলেন, ‘মুজিব ভাইয়ের কাছে আমি খবর
টা দিতে পারলাম না, এর চাইতে বড় দুঃখ আমার আর কি আছে?’ বঙ্গবন্ধু যখন মুক্তি পেলেন,.১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারী
তাজউদ্দীনের অফিসের ফোনটি বেজে উঠল, করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
তাজউদ্দীন ফোন ধরে ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছিলেন না, যুদ্ধবিজয়ী
প্রধানমন্ত্রীর চোখ বেয়ে অঝোরে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী জাতির
পিতা যখন দেশে ফিরে এলেন, মুজিব ভাইকে দেখে তাজউদ্দীনের সে
কি কান্না। এই ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশকে নয়,
বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসেন, কারণ বঙ্গবন্ধুকে ভাল
না বেসে বাংলাদেশেকে ভালবাসা যায় না। (তথ্যসূত্রঃ তাজউদ্দীন আহমদ -
আলোকের অনন্তধারা)
চিরকালই আত্মবিমুখ ছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ। নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করেছেন দেশের
জন্যে, দশের জন্যে।
কিন্তু এই প্রচারবিমুখতাই কি তাঁর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল? হয়ত
এর জন্যেই প্রিয় মুজিব ভাই তাঁকে ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারেননি, কারণ শত্রুর সমালোচনার জবাব যে তিনি কখনোই খোলখুলি ভাবে দিতেন না। তাইতো
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সেই নৃশংস হত্যাকান্ডের পর তাজউদ্দীন বলেছিলেন-
‘মুজিব ভাই জেনে যেতে পারলেন না কে তাঁর বন্ধু
ছিল, আর তাঁর শত্রু।’
দুর্ভাগ্য, সেই হিংস্র ঘাতকের হাত থেকে রক্ষা পাননি তাজউদ্দীনও। বিশেষ আইনে গ্রেপ্তার
হয়ে '৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর তিনিসহ আরো তিন কান্ডারী,
এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম কতিপয় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের বুলেটের আঘাতে নিহত হন,যা 'জেলহত্যা' নামে এদেশের
ইতিহাসের এক ঘৃণিত অধ্যায়। জাতি হারায় তাঁর সূরযসন্তান দের, পতন
হয় ৪ টি উজ্জ্বল নক্ষত্রের!
আজ ২৩ শে জুলাই, বাংলার মানুষের এই প্রিয় নেতার জন্মদিন। ১৯২৫ সালের ২৩শে জুলাই এই মহান
নেতা গাজীপুর জেলার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তাজউদ্দীন এক অণুপ্রেরণার নাম,যা বাংলাদেশের ইতিহাসে চির অমর হয়ে থাকবে।
দেশের প্রতি তাঁর আত্মত্যাগ বাঙ্গালী জাতি স্মরণ করবে হাজার বছর ধরে। সবশেষে বলব
দেশের প্রতি তাঁর নিবেদনের একটি বাণী, যা যেকোন বাঙ্গালির
চোখেই এনে দেবে অশ্রুধারা...
"মুছে যাক আমার নাম, তবু বেঁচে থাক বাংলাদেশ।"
জয় বাংলা!
সালাম নেতা............।।
ReplyDelete"মুকুট তো তাঁর নামেই ছিলো, জন্মেছিলো আজ,
ReplyDeleteশত বুলেটেও মরলো কোথায়, বাংলার বুকে তাজ?"