স্মৃতিচারণ


খন বয়স ১৮ হবে।সালটা ২০১০ এর শেষের দিকে। এইচ এস সি ফার্স্ট ইয়ার। কিশোর রক্তে তখন মিউজিসিয়ান হবার প্রবল আকাঙ্খা। বাবার পকেট থেকে প্রতি রবিবার রাতে ১০০ টাকার একটা নোট চুরি করা আর পর দিন স্টেডিয়াম মার্কেট গিয়ে বাংলা লিজেন্ড সব আর্টিস্টদের অ্যালবাম কেনা নেশা ছিল প্রায়। বাবা সবই জানত কিন্তু বুঝতে দিতনা। মা, বাবার অমতেই গিটারটা কিনে দিল ২০১০ এ।
 আমার খালাত ভাই ফজলে রাব্বি। আহসানুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়ের বিদায়ী ব্যাচ সিভিলের। হুট করে ফোন। কাল জেমস আসবে। চলে আয়। মিরপুরের বাসায় তখন আমি মা আর বাবার ছোট সংসার। স্কুল কলেজ মিরপুরে হওয়ায় একি বাসায় থাকা ১৫ বছর।মিরপুর এর দিকটায় সব চিনি কিন্তু গুলশানের দিকে কিছু একটা তেমন চিনতাম না।কিন্তু ভেতরে কেমন জানি করে উঠলো। জেমস..... সারা রাত বিন্দুমাত্র ঘুম হলো না।
 দিনটা ছিল শুক্রবার। মিরপুর থেকে বাসে ফার্মগেট তারপর রিকশা, ভাইয়া বলে দিল।ঠিক সেরকমই করলাম। যখন তেঁজগাও ঢুকলাম তখন ৩.০০ টা। সে এক আজব দৃশ্য। রাস্তাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল নিমিষেই।প্রকান্ড বড় বড় শত শত ট্রাক।বেগুন বাড়ি হয়ে সোজা অস্ট। ভিতরটা একটু কেঁপে উঠল।সত্যি অসাধারন..!!আর্কিটেকচারাল ভিউটা দারুন। সাদা আর লাল ইটের দুর্গ। তখন ক্যাম্পাসের সামনে টং দোকান গুলো ছিল। আমরা শেষ ব্যাচ যারা পেয়েছি ঐ দোকান গুলো, কিন্তু অনেক কিছুই পাইনি।
 ভাইয়া আসলো ১৫ মিনিট পর। ভিতরে ঢুকলাম। প্লাজা দিয়ে উঠে সোজা গিয়ে সিভিল ডিপার্টমেন্ট পার হয়ে নিচে নামার সিড়ি। অস্ট কেন্টিনে ঢুকলাম।বাহ্ রে বাহ্ এক অন্য জগৎ, অনন্য অনুভূতি। ক্যান্টিনের মাঝের দরজা দিয়ে বের হলেই অস্টিয়ানদের গর্ব রেড এক্স। সত্যি সে সময়ের রেড এক্স ছিল অন্যরকম।কোন বাদাম গাছ ছিল না। তখন রেড এক্স ছিল বহু বিখ্যাত ব্যান্ডের পছন্দের ভেন্যু।
 সম্পূর্ন অস্ট সেজেছে অপূরুপ সৌন্দোর্যে। নীল সাদা মরিচ বাতিতে ঝলমল।অস্টের সোনালি যুগ। লোকাল ব্যান্ড গুলো তুখোড় বাজাচ্ছে। গান্স এন্ড রোজেস, ডিও, স্কিডরো, এল আর বি, আরো কত্ত গান কাভার দিচ্ছে ওরা। ভাইয়া টেনে নিয়ে গেল স্টেইজে। ভলেন্টিয়ারদের সাথে দার করিয়ে দিল। তারপর নিমিষে হাওয়া হয়ে গেল। টিটি গ্রাউন্ডে চোখ পড়তেই দেখি রবিন ভাই। নগর বাউলের গিটারিস্ট।মিটিং এ ব্যস্ত। গুরু আসবে......!!!!
রাত ৮.০০ টা। সাউন্ড চেক হচ্ছে। রেড এক্স থেকে আটতালা, এ এবং সি ব্লক ভর্তি দর্শক কি এক উন্মাদনা। প্লাজাতে সাউন্ড ইন্জিনিয়ার বার বার চেক করছে, কারন গুরু আসবে।।
 রাত ৮.২৫ খবর এল বাতাসে, খবর এল চিৎকারে... গুরু বেইজমেন্টে। করতালিতে ফেটে পড়ল অস্ট, চিৎকারে শুধু একটি শব্দ "গুরু"। ব্যাংক এর লিফট থেকে টিটি গ্রাউন্ড হয়ে ক্যান্টিনের সামনে( যেখানে ব্যানার ওপেনিং এর সময় কেক কাটা হয়) দুধারে হাতে হাত বেধে প্রোটেকশন দেয়া হচ্ছে, ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোতে চোখে ধাধা লেগে যাচ্ছে। ঐতো গুরু আসছেন।।
 হাজার ভক্তের চিৎকারের মধ্যদিয়ে আর রবিন ভাইয়ের গিটারের আমন্ত্রনে তিনি বীরের মত বুক ফুলিয়ে এসে দাড়ালেন স্টেইজে। প্রান প্রিয় গিবসন লেসপল হাতে তুলে নিয়েই দু হাত তুললেন বাতাসে। ভরাট কন্ঠে বললেন "জয় গুরু" এবার একে একে কালজয়ী সব গান। লেইস ফিতা দিয়ে শুরু, বিবাগী,পদ্ম পাতার জল, মিরা বাই। অস্টের দেয়ালে দেয়ালে গুরুর কন্ঠের প্রতিধ্বনি। দর্শক ভক্তদের পাগলামি আরও বেড়ে গেছে। গুরু হুংকার ছেড়ে বললেন " এখানে দুষ্ট ছেলের দলরা কি আছে?"" গানে গানে ছুড়ে দিলেন চুম্বন। মা গানটা গেলেন পরম মমতায়। সব আলো নিভে গেল, সেলফোনের আলোয় অস্ট তখন তারায় তারায় ভোরে গেছে। যেন শরৎ এর মেঘ মুক্ত আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা। গুরু তারায় তারায় রটিয়ে দিলেন সবটুকু ভালবাসা। বলে উঠলেন তোমরা আমার থেকে ভাল গাইছো।
 কপালের ঘাম মুছতে মুছতে গেয়ে ফেললেন ১৬ টি গান।বাজিয়ে চললেন প্রিয় গিটার।শেষে গাইলেন হামারী আধুরি কাহানী। অস্টের আকাশে তখন আতশবাজির খেলা। গুরু শেষ গান করছেন আর চেয়ে চেয়ে দেখছেন। গান শেষে বলেই ফেললেন " তোরা পুরাই পাগল, বাহ্ বেটা বাহ্, তোরা ডাকলেই আমি চলে আসবো, যতদিন তোরা আছিস, ততদিন আমি আছি। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে যদি একি পথে থাকি" ।
 আমার মস্তিস্ক, আমার অনুভূতিতে তখন অদ্ভুৎ পরিপূর্ণতা। এত কাছ থেকে দেখতে পাওয়া নিজের সবথেকে প্রিয় মিউজিসিয়ানকে। সাথে বিদায়ী ব্যাচের আবেগ ঘন এক পরিবেশ। কি এক মায়া অনুভূতিতে এই ক্যাম্পাসের জন্য। কোন কারন তো ছিলনা তখন এই অনুভূতির।হয়তো আত্না খবর পেয়ে গিয়েছিল মাত্র ২ বছর পরই আমি এই পরিবারের একজন সদস্য হব।  
রাত ১.৫৭ নাবিস্কো হয়ে নিকেতন এর দিকে আমি আর ভাইয়া।তখন জানতাম না যেখানে যাচ্ছি তা কিছুদিন পর আমার বর্তমান বাসস্থান এ পরিনত হবে। দুজন একদম চুপচাপ, ভাইয়া বললো , ভার্সিটি কেমন লাগল?? আমি একটা কথাও বলিনি, কান তখনও ঝিঝি করছে। ভাইয়া তার উত্তর পেয়ে গেছে। আজ আমিও অস্টের বিদায়ী ব্যাচ।


 সময় কত দ্রুত চলে যায় আর কতকিছুই দিয়ে যায়, নিবিড়ে অথবা হঠাৎ ঝড়ের বেগে।


সেদিনের অস্ট
           

Comments

  1. সময় আসলেই অনেক দ্রুত চলে যায় !!!!!!

    ReplyDelete
  2. ভালো লিখেছেন। এখন তো এসব কেউ স্বপ্নেও ভাবে না!স্মৃতিচারণ দেখে আর "ইশ যদি আবার হতো" এসব আক্ষেপ নিয়েই অস্টিয়ানরা বিদায় নেয়!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আশাকরি সুদিন ফিরে আসুক

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

মজার খেলা ডার্ট বোর্ড

হাই – লাইন ডিফেন্স ইন ফুটবল

সংখ্যা দিয়ে বন্ধুত্ব!!!