স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল







১৯৭১ সাল।সারাদেশে চলছে যুদ্ধের ডামাডোল।হানাদার বাহিনী সারাদেশে চালিয়ে যাচ্ছে এক ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। এই পরিস্থিতিতে দেশ  মাতৃকাকে রক্ষার জন্যে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ল বাঙ্গালিরা। শুধু যে অস্ত্র দিয়েই বাঙ্গালীরা যুদ্ধ করছিল, তা নয়। কেউ কেউ অস্ত্র হিসেবে  বেছে  নেয়  কাগজ-কলম , কেউবা  ব্যবহার  করে  গলার  স্বর । আরেকটি  দল  ছিল  যারা যুদ্ধ  করেছিল  বল  পায়ে । ফুটবল  দিয়ে । এই ফুটবল যোদ্ধাদের  গল্পই শোনাব আজ........... 


স্থান  সিরাজগঞ্জ জেলা। এখানকার   লালকুটি  ক্যাম্পে পাকিস্তানি  সেনাবাহিনী তাদের একটি ক্যাম্প গড়ে তোলে যুদ্ধের সময়ে।এরপর শুরু করে এখানকার মানুষের ওপর অকথ্য নির্যাতন। এ বর্বরতা থেকে বাদ যায়নি পাশের এলাকাগুলোও। এ অবস্থা দেখে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারেননি তরুণ সাইদুর রহমান। কিভাবে হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়া যায়, তার পরিকল্পনা মাথায় ঘুরতে লাগল  সাইদুরের। 



এক সন্ধ্যায়  সাইদুর  রহমান প্যাটেল  ২৭  জন  তরুণ  নিয়ে  লুট করেন  পাকিস্তানী  সেনা  ক্যাম্প । তারা  ৩১ টি  রাইফেল  নিয়ে  পালিয়ে  যেতে  সক্ষম  হয় । তারপর  তারা  নদীপথে  আসে  নুয়াপুর  গ্রামে। সেখানে  বাংগালী  জওয়ানদের  কাছে   হস্তান্তর  করা  হয়  তাদের  অস্ত্রগুলো । এরপর আগরতলা দিয়ে  তিনি  চলে  আসেন  কলকাতায় ।


কলকাতায়  চলে  এলেও  সাইদুরের  মন  পড়ে  ছিল  তার  নিজ  দেশে । এখানে  বসেই  তিনি  ভাবতেন  দেশের  এই  কঠিন  বিপদে  দেশকে  সাহায্য  করার  কথা । সপ্তাহ  খানেকের  মধ্যে  তার  মাথায়  একটা  চিন্তা  আসে । তিনি  ছিলেন  পাকিস্তান  পিডব্লিউডির  একজন  পেশাদার  ফুটবলার ।এছাড়া  তিনি  প্রিমিয়ার  ডিভিশনেও  খেলতেন । তিনি  চিন্তা  করলেন  তার  এই  খেলাধুলার  অভিজ্ঞতাকে  কাজে  লাগিয়ে  তিনি  যুদ্ধে  অবদান  রাখবেন । সারা  ভারতের  বেশ  কিছু   জায়গায়  তিনি  প্রদর্শনী  ম্যাচ  খেলার  পরিকল্পনা করেন । এতে  করে  মুক্তিযুদ্ধ  ফান্ডকে  যেমন  আর্থিকভাবে   সাহায্য   করা  যাবে  তেমনি  সারাবিশ্ববাসীর  কাছে  স্বাধীন  বাংলাদেশের  গুরুত্বও  তুলে  ধরা  সম্ভব  হবে।







তার  এই  প্রস্তাব  পৌঁছে  যায়  তখনকার   প্রধানমন্ত্রী   তাজউদ্দীন  আহমেদের  কাছে । মুজিবনগর  হেডকোয়ার্টারে  প্রধানমন্ত্রীর   সাথে   সাক্ষাৎ  করতে  যায়  তারা । তাদের  কথোপকথনের  একটি  অংশ  নিচে  তুলে  ধরা হল –


প্রধানমন্ত্রীঃ তোমার  মাথায়  এই  চিন্তা  কীভাবে  এল?

সাইদুরঃ একজন  ফুটবল  খেলোয়াড়  হিসেবে  আমি  সবসময়ই  আমার  দেশের  মুক্তিযোদ্ধাদের  সাহায্য  করতে  চাই  

প্রধানমন্ত্রীঃ প্যাটেল  তোমার  প্রতি  আমার  পূর্ণ  সমর্থন  আছে । তুমি  কী  মনে  কর  তুমি  এটা  করতে  পারবে?

সাইদুরঃইনশাল্লাহ ,  আমরা  পারব


প্রধানমন্ত্রী  তাজউদ্দীন  আহমেদ  তাদের  হাতে  ১৪০০০ টাকা  তুলে দেন  যাতে  তারা  তাদের  কাজ  শুরু  করতে  পারে  এবং  তাদেরকে  পূর্ণ  সমর্থন  দেয়ার আশ্বাস  দেন । সাইদুর  ইন্ডিয়ান  ফুটবল  অ্যাসোসিয়েশনের (আইএফএ)   অনুমতি  ও  প্রস্তুতি  নেয়ার  মাঠের  কথাও  প্রধানমন্ত্রীকে  জানিয়ে  আসেন । 

আইএফএর  অনুমতি  মিললে  তদের  পরবর্তী  লক্ষ্য   ছিল  থাকার  জন্য  বাড়ি  ভাড়া  করা । কার্নেগি  ম্যানশনে  তাদের  একটি  ফ্ল্যাট  পছন্দ  হয়। ফ্ল্যাটটির  মালিক  ছিলেন  আলী  আকবর । তিনি  প্রকৃতপক্ষে  ছিলেন  কুমিল্লার  বাসিন্দা ।ফ্ল্যাটটির  মাসিক  ভাড়া  ছিল  ৪৫০  টাকা  এবং অগ্রিম  ২০০০০ টাকা । কিন্তু  এটা  ছিল  তাদের  সাধ্যের  বাইরে । তাই  সাইদুর  আলী আকবরকে তাদের  পরিকল্পনার  কথা  জানান এবং  অগ্রিম  ২০০০০ টাকা  মওকুফ করার  কথা  বলেন । আলী  আকবর  তাকে  জানান  এটা  দেশের  জন্য  তার  কিছু  করার  সুযোগ । তার  এই  কথায়  দারুণ খুশি  হয়  সাইদুর । 


বেচে যাওয়া টাকা  দিয়ে  তারা  ফুটবলের  জন্য  প্রয়োজনীয়  কিছু  সরঞ্জাম  কেনেন । সেখানে  তাদের  দেখা হয়  আরেক  পেশাদার  ফুটবলার  শেখ  আশরাফ  আলীর  সাথে । তিনি  তৎক্ষণাৎ  তাদের  প্রস্তাবে  রাজি  হয়ে  যান । স্বাধীন  বাংলা  বেতার  কেন্দ্রের  মাধ্যমে  এই  খবর  প্রচার  করা হয়।


প্রায়  ৩০  জন  খেলোয়াড়  কোচ  ননি  বসাকের  অধীনে  ট্রায়ালে  অংশ নেয়। সেখান  থেকে  ২৫ জনকে  বাছাই  করা হয় । এদের  মধ্যে  ছিলেন  কাজী  সালাউদ্দীন , এনায়েতুর  রহমান  খান  , প্রতাপ  শংকর  হাজরার  মত  নামীদামী  খেলোয়াড় । পরবর্তীতে  আরও অনেক  খ্যাতিমান  খেলোয়াড়রা  যোগ দেয়  তাদের  সাথে । ধীরে  ধীরে  মোট  খেলোয়াড়ের  সংখ্যা  বেড়ে  দাঁড়ায়  ৩৬।


১৯৭১  সাল , জুলাইয়ের  ২৪  তারিখ । ইতিহাসের  সাক্ষী  হয়  বাংলাদেশের  প্রথম  ফুটবল  দল । পশ্চিম  বাংলার   কৃষ্ণনগর   স্টেডিয়ামে  জড়ো  হয়  ১৫০০০  দর্শক। প্রতিপক্ষ  ছিল  নদীয়া  একাদশ । সময়  হল  ইতিহাস  তৈরি  করার । ইতিহাসের  রচয়িতা  ১১  জন  শুধু  ফুটবলারই  নন  বরং  সাড়ে  সাত  কোটি  বাঙ্গালীর  চেতনার  বাহক । 


কিন্তু  স্থানীয়  আয়োজকেরা  বাংলাদেশের  পতাকা উত্তোলনের  দাবি  অগ্রাহ্য  করে । প্রায়  ৩০  মিনিট  বাকবিতন্ডার  পর  সমঝোতায়  আসে  তারা । জেলা  প্রশাসক  ডি.কে  ঘোষ  তার  নিজের  চাকরির  ঝুঁকি  নিয়ে  পতাকা  উত্তোলনে  সম্মতি  দেন । দলনেতা  জাকারিয়া  পিনটু  উঁচিয়ে  ধরেন   তৎকালীন   বাংলাদেশের  লাল , সবুজ ও  হলুদ  পতাকা । বিদেশের  মাটিতে  জনসমক্ষে  এটাই  বাংলাদেশের  প্রথম  পতাকা  উত্তোলন । চরম  উত্তেজনার  ম্যাচটি  ড্র  হয়  ২-২  গোলে ।


এই  ম্যাচের  পর  ডি.কে ঘোষকে  চাকরি  থেকে  বরখাস্ত  করা  হয়। পশ্চিমা  মিডিয়ায়  এই  ম্যাচটি  আয়োজনের  জন্য  ইন্ডিয়ান  ফুটবল  অ্যাসোসিয়েসনের  বিরুদ্ধে  খবর  ছাপা  হয় । তখন থেকে  পরবর্তী  খেলাগুলোতে  স্বাধীন  বাংলা  ফুটবল  দলের  সাথে  খেলার  সময়  প্রতিপক্ষ  দল  ছদ্মনাম  ব্যাবহার  করত ।


স্বাধীন  বাংলা  ফুটবল দলের  শেষ  ম্যাচ  হয়  তৎকালীন  বোম্বেতে ( মুম্বাই ) । প্রতিপক্ষ  ছিল  মহারাষ্ট্র  একাদশ । ওই  দলের  দলনেতা  ছিলেন  ভারতের   জনপ্রিয়  ক্রিকেট  প্লেয়ার  মনসুর  আলী  খান  পতৌদি । ওই  ম্যাচে  দর্শকসারিতে  ছিলেন  নানা  গণ্যমান্য  ব্যাক্তি । এইসব  খ্যাতনামা  ব্যাক্তির   উপস্থিতির  কারণে  পুরো  ভারতবর্ষে  আলোড়ন  তৈরি  করে  স্বাধীন  বাংলা  ফুটবল  দল ।



স্বাধীন  বাংলা  ফুটবল  দল  মোট  ১৬ টি  ম্যাচ  খেলে  ওই সময় । যার  মধ্যে  ১৩টি  তে  তারা  জয়লাভ  করে , ২ টিতে হারে  ও  বাকিটি  ড্র হয় । ওই  সফরে  মোট  ৫ লক্ষ  টাকা  আয়  হয়  যার পুরোটাই  মুজিবনগর  সরকারের  হাতে  যুদ্ধের  জন্য  তুলে  দেয়া  হয় ।



স্বাধীন  বাংলা  ফুটবল  দল , সারা  পৃথিবীর  কাছে   হয়তো   এটা  কেবলই  একটা  ফুটবল  দল কিন্তু  বাংলাদেশের  ইতিহাসে  এই  দল  লড়াইয়ের  প্রেরণা , দেশপ্রেমের  উৎস , আত্মত্যাগের  দৃষ্টান্ত  এবং স্বাধীনতার  চেতনার  ধারক    বাহক  মুক্তিযুদ্ধকালীন  সময়ে  খেলার  মাঠে  দেশের  প্রতি  ভালোবাসার  যে  নজির  তারা  স্থাপন  করেছিল  তা  ইতিহাসে  বিরল তাদের  এই  বীরত্বগাঁথা  ইতিহাসের  সাক্ষী  হলেও  ইতিহাসের  পাতায়  বড্ড  ঝাপসা  খেলার  মাঠের  এই  নায়কেরা তবু তারা অমর হয়ে থাকবেন  ইতিহাসের পাতায়, এক গৌরবজ্জ্বল অধ্যায়ের নায়ক হয়ে  । মাতৃভূমির  প্রতি  তাদের  এই  নিবেদন  হাজার  বছর  ধরে  বেঁচে  থাকবে  কোটি  বাঙ্গালির  হৃদয়ে। 


স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল : জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), প্রতাপ শংকর হাজরা (সহ-অধিনায়ক), কাজী সালাহউদ্দিন, নওশেরউজ্জামান, লেঃ নুরুন্নবী, তাসলিম, আইনুল হক, খোকন (রাজশাহী), লুৎফর (যশোর), শেখ আশরাফ আলী, অমলেশ সেন, হাকিম (যশোর), আমিনুল ইসলাম সুরুজ (বরিশাল), বিমল (চট্টগ্রাম), সুভাষ চন্দ্র সাহা (নরসিংদি), মুজিবর রহমান, কায়কোবাদ, ছিরু, সাত্তার, সনজিৎ, মোমেন জোয়ার্দ্দার (চট্টগ্রাম), সাঈদুর রহমান প্যাটেল, পেয়ারা (সাবেক সেক্রেটারি কুষ্টিয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থা), এনায়েতুর রহমান খান, শাহজাহান, অনিরুদ্ধ, নিহার, গোবিন্দ কুন্ডু, প্রয়াত আলী ইমাম, প্রয়াত লালু, প্রয়াত মাহমুদ।



তথ্যসূত্রঃ
https://en.wikipedia.org/wiki/Shadhin_Bangla_Football_Team
http://wikivisually.com/wiki/Shadhin_Bangla_Football_Team
https://www.revolvy.com/main/index.php?s=Shadhin%20Bangla%20Football%20Team&item_type=topic
http://www.londoni.co/index.php/history-of-bangladesh?id=287
http://research.omicsgroup.org/index.php/Shadhin_Bangla_Football_Team


Comments

Popular posts from this blog

মজার খেলা ডার্ট বোর্ড

হাই – লাইন ডিফেন্স ইন ফুটবল

সংখ্যা দিয়ে বন্ধুত্ব!!!