তারেক মাসুদ- এক অনুপ্রেরণার নাম


                                   
                                                        তারেক মাসুদ, চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউট


বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে যে কজন ক্ষণজন্মা পুরুষ জন্ম নিয়েছেন, তার মধ্যে তারেক মাসুদ এক অনন্য নাম। দেশের চলচ্চিত্রে যখন একের পর এক মানহীন, কাহিনীহীন ছবি তৈরি হচ্ছিল, তখন তিনি নিয়ে আসেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার ছবি, যা সাধারণের মাঝে হয়ে ওঠে ব্যাপক জনপ্রিয়। বিশেষত দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার নিয়ে তার চলচ্চিত্রগুলো নিয়ে আসে এক নতুন মাত্রা। যা আমাদের চলচ্চিত্রে সৃষ্টি করে এক নতুন দিগন্ত। বাণিজ্যিক ধারার ছবিতে ভেসে যাওয়া এদেশের চলচ্চিত্র খাতে জহির রায়হান ও আলমগীর কবিরের পর গতানুগতিকতামুক্ত  ছবি তৈরিতে যে কজন পরিচালকের নাম আসে, তার মধ্যে তারেক মাসুদের নাম আসে সবার প্রথমেই। শুধু পরিচালকই নয়, একাধারে তিনি ছিলেন প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার,লেখক, গীতিকার সহ বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী।


তারেক মাসুদের জন্ম ১৯৫৬ সালের ৬ই ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলায়। সেখানেই তিনি মাধ্যমিক জীবন শেষ করেন। পরে নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক ও  স্নাতকোত্তর পাস করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়েই চলচ্চিত্রে তিনি আগ্রহী হন ও এ নিয়ে বিভিন্ন কর্মশালায় যোগ দিতে শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে তারেক মাসুদ নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সোনার বেড়ি’। তবে তারেক মাসুদের প্রথম যে কাজটি তাঁকে সবার সামনে উঠিয়ে আনে, তা হচ্ছে ‘আদমসুরত’। ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া এই ডকুমেন্টারিটি নির্মিত হয়েছিল বিখ্যাত শিল্পী এস এম সুলতানের উপর। এই ডকুমেন্টারিটি নির্মাণ করতে তিনি প্রায় সাত বছর এস এম সুলতানের সাথে অবস্থান করেন।



১৯৯৫ সালে মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’, যা তারেক মাসুদকে এনে দেয় দেশে বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। মার্কিন পরিচালক লিয়ার লেভিনের ধারণকৃত ফুটেজের উপর ভিত্তি করে তিনি এই ডকুমেন্টারিটি তৈরি করেন। জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইডের পরে এটিকেই মুক্তিযুদ্ধের সেরা প্রামাণ্যচিত্র হিসেবে গ্ণ্য করা হয়। যা ১৯৯৭ সালে ফিল্ম সাউথ এশিয়া থেকে বিশেষ সম্মাননা লাভ করে।

২০০২ সালে তাঁর পরিচালনায় মুক্তি পায়  ‘মাটির ময়না’। ১৯৭১ সালের পটভূমিতে তৈরি হয় এই ছবিটি, যাতে এক মাদ্রাসা পড়ুয়া বালকের মাদ্রাসা জীবন, তখনকার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, পরিশেষে মুক্তির সংগ্রাম ও তার  কারণে বালকের জীবনে যে নির্মম পরিহাস ঘটেছিল তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন দারুণ শৈল্পিক নৈপুণ্যে। ছবিটি ২০০২ সালে  কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় ও ফিপ্রেস্কি আন্তর্জাতিক পুরস্কারের আওতায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের সম্মান লাভ করে, যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে এনে দেয় এক অনন্য পরিচয়।

বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল ছবি ‘অন্তরযাত্রা’ মুক্তি পায় ২০০৬ সালে, তারেক মাসুদের পরিচালনায়। দেশে বিদেশে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে এটি অর্জন করে অনেক পুরস্কার।২০০৯ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘নরসুন্দর’। স্বল্পদৈর্ঘ্যের এ ছবিটিতে এক মুক্তিযোদ্ধাকে  পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকার হাত থেকে বিহারীরা বাঁচানোর কাহিনী তিনি তুলে ধরেছেন।  সমসাময়িক ঘটনাও তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি, যার প্রতিফলন আমরা তাঁর ‘রানওয়ে’ ছবিটিতে দেখতে পাই। ছবিটিতে ধর্মীয় উগ্রবাদে জড়িয়ে যাওয়া এক নিম্নবিত্ত যুবকের জীবনকাহিনী দেখতে পাই, যা ২০০৪-০৫ সালের তৎকালীন জঙ্গিবাদের পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করেই মূলত নির্মাণ করেন তিনি। এটিই ছিল তাঁর নির্মাণ করা শেষ ছবি। তাঁর অন্যান্য চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টারির মধ্যে রয়েছে- এ কাইন্ড অফ চাইল্ডহুড, নারীর কথা, মুক্তির কথা, ইন দ্য নেইম অফ সেফটি, ভয়েসেস অফ চিলড্রেন, সে, ইউনিসন । স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈঘ্য, প্রামাণ্যচিত্র ও এনিমেসশন মিলিইয়ে মোট ১৬ টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি। এছাড়া লেখালেখিতেও তিনি যুক্ত ছিলেন।

তারেক মাসুদ তাঁর ছবিগুলোকে শুধু বাণিজ্যিক ধারায় বা শুধুমাত্র হলে মুক্তি পাওয়ায় আটকে রাখেননি। ছবিগুলোকে তিনি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়।বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল কলেজে ছবিগুলো প্রদর্শনের ব্যবস্থা তিনি করতেন, যা তরুণ সমাজকে পুনরায় ফিরিয়ে এনেছে তাদের ইতিহাসের মূলে।

ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর সহধর্মিণী ছিলেন ক্যাথরিন মাসুদ, যিনি তারেক মাসুদের জীবনের প্রায় প্রতিটি সৃষ্টিশীল কাজে যুক্ত থেকেছেন।

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের উপর তিনি বানাতে চেয়েছিলেন ‘কাগজের ফুল’ নামের একটি ছবি, তারই লোকেশন দেখে ফিরছিলেন। পথে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ক্ষণজন্মা এ কীর্তিমান পুরুষ। চলচ্চিত্র হারায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে।

তারেক মাসুদ এক অনুপ্রেরণার নাম, যাকে অনুসরণ করেই আমাদের চলচ্চিত্র এগিয়ে যাবে শত সহস্র বছর ধরে এক সীমাহীন উচ্চতায়।






Comments

Popular posts from this blog

মজার খেলা ডার্ট বোর্ড

হাই – লাইন ডিফেন্স ইন ফুটবল

সংখ্যা দিয়ে বন্ধুত্ব!!!