রাজপথের চলন্ত ক্যানভাসের গল্প!
নগর জীবনে যান হিসেবে রিকশা
এক অনন্য স্থান দখল করে আছে অনেককাল আগ থেকেই। প্রতিদিনই আমরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়
যেতে রিকশা ব্যবহার করে থাকি। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, অনেক রিকশার পেছনেই আঁকা
থাকে রং বেরঙ্গের নানা অলংকরণ। এগুলো যেমন
রিকশার সৌন্দর্য বাড়ায়, তেমনি যোগায় বিনোদনের
খোরাক, আবার অনেক সময় তুলে আনে সমাজের নানা চিত্র। এই রিকশাচিত্র আমাদের দেশের সংস্কৃতির
এক আলাদা ধারায় স্থান করে নিয়েছে। রিকশার পেছনের এই চিত্রকলাকে ফোক আর্ট, পপ আর্ট বা
ক্র্যাফট বলা হয়ে থাকে। রিকশাচিত্রের এই ধারা আমাদের সংস্কৃতিরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রিকশার পেছনের এই চিত্রকলাকে অনেকেই গ্রামীণ সংস্কৃতির ফোক আর্টের মধ্যে ধরে থাকেন। একটা সময় ছিল, এই ধরণের ফোক আর্ট শুধু গ্রামীণ শিল্পেই সীমাবদ্ধ ছিল। ধীরে ধীরে এই শিল্প শহুরে জীবনে প্রবেশ করে, পেয়ে যায় শিল্পের এক বিশেষ ক্ষেত্রের স্থান। শিল্প সংস্কৃতি, ইতিহাস, দৈনন্দিন জীবনের নানা দিক ফুটে উঠতে থাকে রিকশার পেছনে, তুলির আঁচড়ে।
রিকশার পেছনের এই চিত্রকলাকে অনেকেই গ্রামীণ সংস্কৃতির ফোক আর্টের মধ্যে ধরে থাকেন। একটা সময় ছিল, এই ধরণের ফোক আর্ট শুধু গ্রামীণ শিল্পেই সীমাবদ্ধ ছিল। ধীরে ধীরে এই শিল্প শহুরে জীবনে প্রবেশ করে, পেয়ে যায় শিল্পের এক বিশেষ ক্ষেত্রের স্থান। শিল্প সংস্কৃতি, ইতিহাস, দৈনন্দিন জীবনের নানা দিক ফুটে উঠতে থাকে রিকশার পেছনে, তুলির আঁচড়ে।
মূলত পঞ্চাশের দশকে এদেশে
রিকশাচিত্রের প্রচলন শুরু হয়। তখন রিকশার পেছনে টিন শিটের উপর এনামেল পেইন্টে ছবি আঁকা
হত। ঢাকা ও রাজশাহীর রিকশাগুলোতে এর চল ছিল সবচেয়ে বেশি। এদিকে কিছুটা রক্ষণশীল মনোভাবের
কারণে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ইত্যাদি এলাকার
রিকশায় তেমন কোন ছবি দেখতে পাওয়া যেত না। ষাটের দশকে ঢাকাই রিকশায় এই রিকশাচিত্র ব্যাপক
হারে জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে। নানা ধরণের রং বেরঙ্গের ফুল, মিনার, মসজিদ ইত্যাদির ছবি
তখন আঁকা হত বেশি। স্বাধীনতার পরে যুদ্ধের অনেক ঘটনার উপর ভিত্তি করে আঁকা হতে শুরু
করে ছবি।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, পাক বাহিনীর অত্যাচার, বিজয়ের মুহূর্ত, রাস্তায় ট্যাংকের
সারি রিকশার পেছনে ফুটিয়ে তুলেন আঁকিয়েরা। এছাড়াও, তখনকার সময়ে সাধারণের মধ্যে বিনোদনের
প্রধান খোরাক ছিল চলচ্চিত্র। ফলে, ছবি আঁকায় গুরুত্ব পেতে থাকে নায়ক নায়িকাদের ছবি,
কখনও বা তাদের প্রেম, বা জীবনের নানা ট্র্যাজেডি। মানুষ তাদের পছন্দের ছবির দৃশ্য,
নায়ক নায়িকাদের ছবি দেখতে পেয়ে হত দারুণ উল্লসিত। চলচ্চিত্র ভিত্তিক এই সব ছবি নাগরিক
সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ায় রিকশার বডির পেছনে একচেটিয়া স্থান দখল করে নেয়।
রূপালী পর্দার রাজ্জাক-শাবানা,
জসিম, মান্না, শাবনূর এদের ছবিই বেশি দেখা যেত ৯০ এর দশকের বেশিরভাগ রিকশাচিত্রে। শুধু
নায়ক নায়িকায় নয়, ছবির ভিলেনের ভয়ংকর রূপও ফুটে উঠত ছবিতে। নায়ক নায়িকার প্রেমকাহিনী,
বিরহগাথা, ভিলেনের খলরূপ কে চমৎকারভাবে উঠিয়ে আনা হত রিকশার পেছনে। তবে এই সময়ের আস্তে
আস্তে দেখা দিতে থাকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের নায়ক নায়িকাদের, ফলে আস্তে আস্তে উঠে যেতে
শুরু করে বাংলাদেশের তারকাদের ছবি।
শুধু যে এই চিত্রশিল্পে
নায়ক নায়িকাদের ছবি ফুটে উঠত তা কিন্তু নয়। গ্রামীণ বাংলার প্রকৃতি, সেখানকার জনজীবন,
মাছ ধরার দৃশ্য, ধান কাটার দৃশ্য এসব জিনিসও ফুটিয়ে তোলা হয় ছবিতে। অনেকসময় হাস্যরস
সমৃদ্ধ অনেক ছবিও দেখা যায় এখানে। আবার বিভিন্ন রকম জীবজন্তুর ছবিও আমরা অনেক সময় দেখতে
পাই। এছাড়া নামাজরত শিশু, কোরানশরীফ পাঠরত বালক বালিকার ছবি খুব হরহামেশাই রিকশার পেছনে
আমরা এখনো দেখি।
রিকশার পেছনে এই ছবি আঁকার
কারিগররা খুব সাধারণ শ্রমিকশ্রেণীর। তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও, নিজেদের
হাতের তুলির যাদুতে এরা ফুটিয়ে তোলে অসাধারণ সব ছবি। মূলত ভালোলাগা, ছবি আঁকার প্রতি
ভালোবাসা থেকেই তাদের এই জগতে আসা। কেউবা শিখেছেন পূর্বসূরিদের কাছ থেকে, কেউবা পুরোপুরি
নিজেই এঁকে চলেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। বলা যায়, এরাই আমাদের এই শিল্পকে সবার সামনে
তুলে ধরার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে চলেছেন নীরবে, নিভৃতে।
যান্ত্রিক এই যুগে রিকশার
কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন এসেছে, ফলে ক্যানভাসে ছবি ফুটিয়ে তোলা অনেকটাই যেন কমে যেতে
শুরু করেছে ছবি আঁকার স্থান অপ্রতুলতায়। এছাড়া অনেক রিকশা মালিক আলাদা করে খরচ করে
আর আঁকাতে চাননা এখন। ফলে ধীরে ধীরে অনেকটা স্তিমিত হতে শুরু করেছে এই শিল্প। এছাড়া
কম্পিউটার গ্রাফিক্সের মাধ্যমে খুব সহজেই এসব কাজ আজকাল করে ফেলা যায়, ফলে হাতে আঁকা
ছবি অনেকটাই কমে এসেছে। অনেক আঁকিয়েরা এই পেশা ছেড়ে চলে যেচ্ছেন জীবিকার তাগিদে।
রিকশার পেছনের এই চিত্রকলা
শুধু আমাদের দেশেই যে খ্যাতি অর্জন করেছে তা নয়। সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রদর্শিত
হয়েছে আমাদের এই শিল্প, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। কিছুটা স্তিমিত হলেও এর কদর
যে একেবারে কমে যায়নি। তাই প্রযুক্তির এই যুগে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই বাঁচাতে হবে
আমাদের এই শিল্পকে, রিকশার পেছনের ছবিতে আমাদের ঐতিহ্যকে। প্রাণ থাকুক প্রতিটি রিকশার পেছনের টিনের ক্যানভাসটিতে।
কালো পিচের রাস্তায় ছুটে
চলেছে একটি রিকশা, যার পেছনে আঁকা নায়ক নায়িকার গভীর প্রণয়ের একটি মুহূর্ত, চোখ জুড়াবার
মত একটি দৃশ্য!
Comments
Post a Comment