চলচ্চিত্রের সেইসব দিনগুলি! - পর্ব ৩

                                                 ১৯৭১: ক্যামেরাই যখন রাইফেল

এল ১৯৭১। ২৫ শে মার্চ এদেশের মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ল হানাদার বাহিনী।নির্বিচারে হত্যা করে চলল মানুষকে। বাংলার মানুষ ও থেমে রইল না। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সারা বাংলায় মানুষ ঝাপিয়র পড়ল যুদ্ধে। লড়াই চলল দেশমাতৃকাকে মুক্তির জন্যে, সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্যে।

দেশের এই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে বসে ছিলেন না এদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষেরা। তারাও ঝাপিয়ে পড়লেন তাদের ক্যামেরাটি কাধে নিয়ে। গণমানুষের লড়াইকে তারা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরতে লাগলেন। ক্যামেরা হয়ে উঠল তাদের রাইফেল। তৈরি করা হচ্ছিল যুদ্ধকালীন অবস্থা নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র। সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচন, ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর সেই কাপন ধরানো ভাষণ, গণহত্যা, শত শত মুক্তিযোধাকে নিয়ে খন্দকার মোশারফ হোসেনের শপথবাক্য পাঠ করানো, মানুষের লাশের স্তূপ, প্রাণভয়ে দেশত্যাগের চিত্র, লাশের উপর শকুন কুকুরের লড়াই ইত্যাদি ঘটনা নিয়ে তৈরি হতে লাগল অসংখ্য প্রামাণ্যচিত্র। পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য উভয়রূপেই উঠে আসে এদেশের মুক্তিসংগ্রাম।

তখনকার বিরূপ পরিস্থিতি সারা বিশ্ববাসীকে জানানোর একমাত্র বৃহৎ মাধ্যম হয়ে হঠে আমাদের প্রামাণ্যচিত্র গুলো। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে জহির রায়হান। নির্মাণ করেন তাঁর সেই বিখ্যাত যুদ্ধচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’। এ প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমেই সারা বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে, কি বর্বরতা পাকিস্তানী সেনাবাহিনী চালাচ্ছে বাঙ্গালির উপরে। ২০ মিনিটের এ যুদ্ধচিত্র সারা বিশ্ববাসীকে করে দেয় হতবাক। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে বহির্বিশ্বে গড়ে উঠতে থাকে জনমত। যুদ্ধক্ষেত্রে  বাঙ্গালির মনে সাহস জোগায় এ প্রামাণ্যচত্র।  মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই তিনি বানাতে চেয়েছিলেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র  ‘ধীরে বহে মেঘনা’। কিন্তু যুদ্ধের পরই তিনি নিখোঁজ হওয়ায় তা বানিয়েছিলেন আলমগীর কবির।

                                           স্টপ জেনোসাইড যুদ্ধচিত্রের কিছু ছবি
                              



মুজিবনগর সরকার গঠিত হবার পর তারা বুঝতে পারে, সারা বিশ্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায় করতে চলচ্চিত্র হয়ে উঠতে পারে এক অনন্য মাধ্যম। ফলে ভারত সরকারের সহযোগিতায় চলচ্চিত্র নিরমাণের আলাদা বিভাগ খোলা হয়। এ বিভাগ থেকে যুদ্ধের উপর চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য বিভিন্ন আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হত। ফলে জহির রায়হানের মত আরো অনেক চলচ্চিত্রকার তখন এগিয়ে আসেন। আলমগীর কবির নির্মাণ করেন ‘লিবারেশন ফাইটারস’। বাবুল চৌধুরী নির্মাণ করেন ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স’। জহির রায়হান আরো নির্মাণ করেন ‘এ স্টেট ইজ বর্ণ’।


যুদ্ধের এ ভয়াবহ সময়টতে মানুষের মনে সাহস জোগাতেও চলচ্চিত্রকার, অভিনেতা, সংস্কৃমকর্মী্রা পালন করেন এক অভূতপূর্ব ভূমিকা। তাঁরা ছুটে যান শরণার্থী শিবিরগুলোতে, , মানুষকে শোনাতে থাকেন আশার বাণী। পরবর্তীতে যুদ্ধের ২২ বছর পর তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ তাঁদের ‘মুক্তির গান’ প্রামাণ্যচিত্রে তা তুলে ধরেন।





যুদ্ধকালীন সময়ের এসব চলচ্চিত্রই সমগ্র বিশ্ববাসীকে বাঙ্গালির পক্ষে এক হতে সাহায্য করেছিল। রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের যুগিয়েছে সাহস, করেছে উজ্জীবিত।ক্যামেরাই হয়ে উঠেছিল শত্রুর বিরুদ্ধে রাইফেল । যা আজো মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য প্রামাণ্য দলিল ব্যবহৃত হচ্ছে। যা আবারো প্রমাণ করেছে, সংস্কৃতিই হতে পারে যে কোন অপশক্তির বিরুদ্ধে উপযুক্ত হাতিয়ার! 

Popular posts from this blog

মজার খেলা ডার্ট বোর্ড

হাই – লাইন ডিফেন্স ইন ফুটবল

সংখ্যা দিয়ে বন্ধুত্ব!!!