কর্ণফুলীর সাম্পান


ত্তাল কর্ণফুলী নদীর বিশাল সব তরঙ্গ ভেঙ্গে সাহসী ভঙ্গিতে এগিয়ে চলা এক নৌকার নাম সাম্পান। চট্টগ্রামের শত বছরের ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই নাম। মাঝির বলিষ্ঠ হাতের দক্ষতায় দুই বৈঠার এই নৌকা একসময় শাসন করে বেড়াত চট্টগ্রামের নদী ও সমুদ্র। গলুইয়ের উপর বসে দরাজ গলায় গান গাইতে গাইতে সাম্পান নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিতেন মাঝিরা। হালবিহীন এই নৌকা মাঝির দুই হাতের দক্ষতায় অনায়াসে পাড়ি দিত বিশাল সমুদ্র পথ। 


তবে বর্তমানে অবস্থা ভিন্নরূপ, উত্তাল কর্ণফুলী এখন অনেকটাই শান্ত। মাঝির কষ্ট কমিয়ে দিয়েছে ইঞ্জিন, গানের সুরে দখল বসিয়েছে ইঞ্জিনের ভট ভট শব্দ!! মুমূর্ষু সাম্পান এক আর্তনাদ নিয়ে চলে নিথর কর্ণফুলীর বুকে।

সাম্পান শব্দের উৎপত্তি চীনা শব্দ সাং পাং (তিন মাথা) হতে, সাম্পানেও উপরের দিকে তিনটি অংশ দেখা যায়। চীন, বার্মা, মালয়, জাভা, সিঙ্গাপুর এর বন্দরগুলোতে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম হতে বণিকদের নিয়মিত যাতায়াতের সুবাদে পরিচিয় ঘটে সাম্পানের। বিশেষ আকৃতির কারণে অনায়াসে সমুদ্র পাড়ি দেয়ার  ক্ষমতা আকৃষ্ট করে এদেশীয় বণিকদের। বিস্ময়কর এই যান হাঁসের মত চলাচলে সক্ষম।


চট্টগ্রামের ১২'শ বছরের নৌ শিল্পের ইতিহাসে এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী সাম্পান।একসময় কর্ণফুলীর বুকে প্রায় দুই হাজারের মত সাম্পান দেখা যেত যা বর্তমানে কয়েকশ'তে এসে দাড়িয়েছে। সাম্পান মূলত মালামাল ও যাত্রী পরিবহণে ব্যবহৃত হয়। একসময় বিশাল জাহাজগুলো থেকে যাত্রীদের পাড়ে নিয়ে আসার জন্য সাম্পান ব্যবহার করা হত।একটি মালবাহী সাম্পান একসাথে প্রায় আট থেকে দশ হাজার মণ মালামাল নিয়ে যাত্রা করতে পারত। মালবাহী সাম্পান গুলো ১৯৮০ সালের পরই বিলুপ্ত হয়। একটি ছোট আকৃতির সাম্পান দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০ ফুট ও প্রস্থে সাড়ে ৪ ফুট। এতে ১৫-১৮ জন মানুষ বসতে পারে। বড় আকারের একটি সাম্পানের ধারন ক্ষমতা প্রায় ৩০-৩৫ জন। বর্তমানে মূলত চট্টগ্রাম ও কুতুবদিয়ায় সাম্পানের দেখা মেলে।



একসময় বহু মানুষের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন ছিল এই সাম্পান। মূলত চট্টগ্রামের হালিশহর, কোলাগাঁও, বরকল, সন্দীপ, মহেশখালী, কুতবদিয়া, মাতারবাড়ি, চৌফলদন্ডি, ঘুন্ধুম, টেকনাফ প্রভৃতি জায়গায় ছিল সাম্পানের কারখানা। এসব কারখানায় সেগুন, চাপালিশ, গামারি কাঠের সাম্পান তৈরী হত। একটি সাম্পান তৈরী হতে সময় লাগত প্রায় ১৫ দিন। সাম্পান শ্রমিকেরা অধিকাংশই ছিলেন মুসলিম।

চট্টগ্রামের প্রাচীনতম ঘাট অভয়মিত্রের ঘাট একসময় ছিল নগরের সবচেয়ে ব্যস্ততম ঘাট। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণাংশের এই ঘাটে বিশাল সব সাম্পানে করে আসত কাপড়,তরি-তরকারীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা দ্রব্য়। সাম্পান ভিত্তিক বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র ছিল এই ঘাটটি যা এখন মৃতপ্রায়। 


হাজার বছরের চট্টগ্রামের ঐতিহ্য সাম্পান আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। শত প্রতিকুলতার মাঝে টিকে থাকা মাঝিরাও আজ খুঁজছেন বিকল্প আয়ের উৎস। তবে এতকিছুর মাঝেও জীবন পেয়েছে সাম্পান । ‘কি গান মাঝি হুনাইলা, কি বাঁশি মাঝি বাজাইলা/ কর্ণফুলীর সাম্পানওয়ালা/ আঁর মন হরি নিলা...’ অথবা শেফালী ঘোষের “ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দেওয়ানা” ‘ওরে কর্ণফুলী রে, সাক্ষী রাখিলাম তোরে...’ এর মত বিখ্যাত সব আঞ্চলিক গানের মাধ্যমে সাম্পান আজও বেঁচে আছে মানুষের মুখে মুখে। 

Comments

Popular posts from this blog

মজার খেলা ডার্ট বোর্ড

হাই – লাইন ডিফেন্স ইন ফুটবল

সংখ্যা দিয়ে বন্ধুত্ব!!!