জীবন যার ছবির, ছবিই যার জীবন

Satyajit Ray
                                                                         সত্যজিত রায় by Rishiraj Sahoo                                                          
সাল ১৯২১, ২রা মে। স্থান কলকাতা।

সকাল থেকেই  রায় পরিবারে চলছে উৎসবের আমেজ। আজ যে আসবে নতুন শিশু, তাকেই বরণ করবার আয়োজন চলছে। এমনই সময় বাবা সুকুমার রায়ের কাছে খবর এল, তার এক পুত্র সন্তান জন্ম নিয়েছে। সমস্ত বাড়ি হল উচ্ছ্বসিত।

বালকের নাম রাখা হল সত্যজিত রায়।

খ্যাতনামা রায় পরিবারে জন্ম নেয়া এ বালকটি যে একসময় পুরো পৃথিবী কাপাবে, তা কি তখন কেউ জানত!

বাড়ীর সবার কাছেই তিনি বড় আদরের ছিলেনএকমাত্র পুত্র সন্তান হওয়ায় মা বাবার কাছেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত আদরের। বাড়ীতে সবসময়ই থাকত এক সাংস্কৃতিক আবহ ,ফলে তিনি বেড়ে উঠছিলেন এক মুক্ত পরিবেশে। পিতা সুকুমার রায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবিদের একজন।মা সুপ্রভা ছিলেন সংগীত শিল্পী। পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় ছিলেন বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক,লেখক, শিশুতোষ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। হয়ত বংশের ধারাবাহিকতায় , তিনি হয়েছিলেন অনন্য প্রতিভার অধিকারী।


সত্যজিত আট বছর বয়েসে বালিগঞ্জ সরকারী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন ।মূলত  স্কুলে থাকাকালেই সিনেমার প্রতি তার প্রেম শুরু হয়।নিয়মিত হলিউড এর খবর পড়তেন, বাদ যেত না টুকিটাকিও।স্কুলের পড়াশুনো শেষ করে তিনি ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে১৮ বছর বয়েসে তিনি গ্র্যাজুয়েট হন ও পড়াশুনো ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।সিদ্ধান্ত নেন, বাণিজ্যিক চিত্রকর হবেন।ছবি আঁকায় তাঁর  ছিল সহজাত প্রতিভা। তা দেখে মা তাকে শান্তিনিকেতনে পেইন্টিং নিয়ে পড়বার উপদেশ দেন। একটু আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি পরে তা মেনে নেন।

সাল ১৯৪৯ কলকাতায় আসেন ফরাসি নির্মাতা জঁ রনোয়ার। উদ্দেশ্য দ্য রিভার এর শ্যুটিং। সত্যজিৎ তাকে এই ছবির লোকেশন খুজতে সহায়তা করেন। তিনি রনোয়ারের সাথে ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ নিয়ে কথা বলেন ও রনোয়ার তাকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দেন।

এরপর আসে ১৯৫০ সাল । সত্যজিৎ তখন লন্ডনে। এখানে প্রায় তিনমাস অবস্থান করেছিলেন। দেখে যাচ্ছিলেন একের পর এক ছবি। এরিমধ্যে একদিন তিনি দেখলেন ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি Ladri di biciclette ( বাইসাইকেল চোর) সেদিনই ছবিটি দেখে হল থেকে বেরিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি একজন চলচ্চিত্রকার হবেন, যা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়

                                                   
এরপরের কাহিনী শুধুই এগিয়ে যাবার ১৯৫৫ সালে তিনি নির্মাণ করেনপথের পাঁচালী’, যা বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে সৃষ্টি করে এক নতুন দিগন্ত ছবিতে শিশু চরিত্রে অপুর অভিনয় সবার নজর কেড়ে নেয়যেখানে সত্যজিত বিশের দশকে গ্রাম বাংলার জীবনধারা সবার সামনে ফুটিয়ে তোলেনস্বাধীন ভারতে এটিই প্রথম চলচ্চিত্র, যা আন্তঃজাতিক মনোযোগ টানতে সক্ষম হয় পথের পাচালীর ধারাবাহিকতায় সত্যজিত ১৯৫৭ সালে নির্মাণ করেনঅপরাজিত’, যাতে অপুর শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ ও কলকাতার কলেজে পড়ার গল্প তুলে ধরা হয় বরাবরের মত এটিও দর্শকের কাছে জনপ্রিয়তা পায় ছবিটি ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় অপু ট্রায়োলজীর শেষ পর্ব- অপুর সংসার, যাতে অভিনয়ের অভিষেক ঘটে বিখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যাতে সত্যজিত ফুটিয়ে তোলেন যুবক অপুর জীবনের নানা মোড়, অপু- অপর্ণার সেই বিখ্যাত জুটি

একে একে তিনি নির্মাণ করেন- পরশপাথর( ১৯৫৮), জলসাঘর (১৯৫৮), দেবী( ১৯৬০), কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৬২), অভিজান(১৯৬২), মহানগর (১৯৬৩), চারুলতা ( ১৯৬৪), মহাপুরুষ (১৯৬৫), নায়ক (১৯৬৬), চিড়িয়াখানা (১৯৬৭), গুপী গায়েন বাঘা বায়েন ( ১৯৬৮), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৬৯), প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০), সীমাবদ্ধ (১৯৭১), অশনি সংকেত (১৯৭৩) , সোনার কেল্লা ( ১৯৭৪) , জানা অরণ্য (১৯৭৫), জয় বাবা ফেলুনাথ ( ১৯৭৯), হীরক রাজার দেশে ( ১৯৮০), ঘরে বাইরে (১৯৮৪), শাখা প্রশাখা (১৯৯২) , আগন্তুক (১৯৯২) ইত্যাদির মত দারুণ সব ছবি, যা আজো বাঙ্গালির কাছে তুমুল জনপ্রিয়। 

সত্যজিৎ তাঁর ছবিতে যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনধারা, তাদের জীবনের গতি, উঠানামা, তেমনই তিনি তুলে ধরেছেন সমসাময়িক সমাজ ব্যবস্থার নানা অসংগতি, কুসংস্কার তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষাপটে নারীমুক্তি বিষয়টি তাঁর নানা ছবিতে প্রকাশ পেয়েছে , যা আমরা তাঁরঘরে বাইরেছবিটিতে দেখতে পাই পরিপক্ক সম্পর্ক আর প্রেমের ছবিচারুলতা’  এ যাবতকালের রবীন্দ্রসাহিত্য নির্ভর অন্যতম সেরা ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হয় অনেক সমালোচকের মতে, চারুলতাই ছিল তাঁর জীবনের সফলতম ছবি

এবার একটা মজার বিষয়ে আসা যাক সত্যজিতের ছেলে সন্দ্বীপ একদিন বাবার কাছে অভিযোগ করল, তার বাবা কেবলি বড়দের জন্য ছবি বানান, ছোটদের জন্য কিছুই করেন না পুত্রের এ অভিযোগ পিতা আমলে নিলেন তৈরি করলেন গুপি গায়েন বাঘা বায়েন, যাতে গুপী আর বাঘা ছিল ভূতের রাজার বর পাওয়া দুজন লোক, যারা গান গেয়ে আর ঢোল বাজিয়ে বেড়াত এ ছবিটি তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা ব্যবসাসফল একটি ছবি।

হীরক রাজার দেশে- প্রতিটি বাঙ্গালীর মন ছুয়ে যাওয়া, সর্বকালের অন্যতম সেরা একটি ছবি, যাতে সত্যজিৎ প্রজাকুলের উপর শাসকসমাজের নানা নিপীড়নের কাহিনী তুলে ধরেছেন, তবে মজার বিষয়, গুপী গায়েন বাঘা বায়েন, হীরক রাজার দেশে ছবিতে তিনি দেখিয়েছেন, কোন অন্যায়ই চিরস্থায়ী হতে পারে না, সকল দুষ্টের নাশ একদিন হবেই যা আমাদের বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে সময়োপযোগীপ্রসঙ্গত, হীরক রাজার দেশে ছবিটি তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থা ঘোষনাকালীন সরকারের প্রতিফলন মহাপুরুষ  ছবিটিতে তিনি দেখিয়েছেন এক সাধুর ভন্ডবৃত্তি, যা পরে আর টিকতে পারেনিদেবীছবিতে তিনি দেখিয়েছেন হিন্দু সমাজের নানা মজ্জাগত কুসংস্কার

 আর হুম, সত্যজিতের ছবি যে কেবল ভারতের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা কিন্তু নয় একটা উদাহরণ দেয়া যাক পথের পাঁচালী সবে বের হয়েছে সারা ভারতে তো বটেই,সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তা সাড়া ফেলেছিল যদিও দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এর প্রভাবশালী সমালোচক এর কঠোর সমালোচনা করে বলেছিলেন-কৃষক হাত দিয়ে ভাত খাচ্ছে, এ দৃশ্যসম্বলিত ছবি আমি দেখব না কিন্তু এর বদলে ছবিটি বহুদিন ধরে সেখানে প্রদর্শিত হয়

শুধু যে ছবি বানাতেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি, তা কিন্তু নয় বেশ ভাল ছবিও আঁকতেন তিনি পিতামহের প্রতিষ্ঠিতসন্দেশপত্রিকাটি তিনি আবার চালু করেন,যার ভেতরের ছবি তিনি আঁকতেন আর শিশুদের জন্য গল্প ও প্রবন্ধ লিখতেন

সত্যজিত নিজেকে ছবির জগতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, বাংলা সাহিত্যেও তাঁর অবদান কম নয় ছোটবেলায় আমাদের কল্পনার জগতে যে ডিটেকটিভ ফেলুদা আর তোপসে ঘুরে বেড়াত, তা কিন্তু ইনারই সৃষ্টি আর কল্পবিজ্ঞানের সেই প্রোফেসর শঙ্কু, যে কিনা বিজ্ঞানের সব কিছু জানত,আরো জানত ৬৯ টা ভাষা, দেশপ্রেমিক , তাও এই সত্যজিৎ রায়েরই সৃষ্টি!

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সত্যজিৎ ছবি নির্মাণের কথা ভেবেছিলেন, তবে পরে  এ পরিকল্পনা তিনি ত্যাগ করেন এ বিষয়ে তিনি বলেন- একজন পরিচালক হিসেবে শরণার্থীদের বেদনা ও জীবন নিয়েই তিনি আগ্রহী, তাদের নিয়ে রাজনীতি নিয়ে নন

সত্যজিৎ তাঁর জীবদ্দশায় প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন। তিনিই দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, যাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট প্রদান করে।.১৯৮৭ সালে তিনি ফ্রান্স সরকারের কাছ থেকে পান লেজিওঁ দনরে। ১৯৮৫ সালে ভারত সরকার তাকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রদান করেন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তিনি পান ‘ভারতরত্ন’। চলচ্চিত্র অঙ্গনের সবচে বড় পুরস্কার ‘অস্কার’ তিনি যখন পেয়েছিলেন, তখন তিনি হাসপাতালের বেডে। তবে সত্যজিৎ তাঁর জীবনের সবচে বড় যে পুরস্কারটি পেয়েছিলেন, তা হলো, বাঙ্গালীর ভালবাসা!

১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল এ ক্ষ্ণজন্মা মানুষটি চলে যান পরপারে।
তাঁর মৃত্যুতে পুরো কলকাতায় নেমে আসে স্থবিরতা, পুরো কলকাতা তাঁর বাড়িতে ভেঙ্গে পড়ে।
সত্যজিৎ রায় বাংলা চলচ্চিত্রে একটি অনুপ্রেরণার নাম। যুগ যুগ ধরে যে নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। যতদিন বাংলা চলচ্চিত্র থাকবে, ততদিনই বাঙ্গালির মনে তিনি অমর হয়ে রবেন। অমর হয়ে রবে তাঁর সৃষ্টিসম্ভার। তাঁকে অনুসরণ করেই তৈরি হবে আরো অনেক চলচ্চিত্র, যা বাংলা ভাষা তথা সংস্কৃতিকে নিয়ে যাবে অনন্য এক উচ্চতায়।
জাপানি পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার তাঁর এক উক্তিতে বলেছিলেন- সত্যজিতের ছবি না দেখা আর পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র সূর্য না দেখা একই কথা!

তাই চলুন না, এখুনি বসে পড়ি, দেখা হয়ে  যাক তাঁর একটি ছবি ! 

                                  

Comments

  1. বাংলা চলচ্চিত্রের মহান পথিকৃৎ সত্যজিৎ .......

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

মজার খেলা ডার্ট বোর্ড

হাই – লাইন ডিফেন্স ইন ফুটবল

সংখ্যা দিয়ে বন্ধুত্ব!!!